উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণ: আলোর নিচে অন্ধকার

Slider টপ নিউজ

110850_UN-website

 

ঢাকা: স্বল্পন্নোত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এখন ছয়-বছর ব্যাপী নির্ধারিত পর্যায়কাল ঠিকঠাকভাবে অতিক্রম করলেই ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে দেশটি। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা আশঙ্কা করছেন, সামনে অপেক্ষা করছে কঠিন সময়।
একটিমাত্র রপ্তানি খাতের দিকে মনোযোগ, অবকাঠামোগত উন্নয়নে ধীরগতি এবং শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমশক্তির অভাবের কারণে এই উত্তরণের স্বীকৃতি হয়ে দাঁড়াতে পারে দেশটির গলার কাঁটা। হংকং-ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম এশিয়া টাইমসের এক প্রতিবেদনে এই পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়, উত্তরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) কাতার থেকে বের হয়ে আসবে। আর তখনই কিছু নির্দিষ্ট সুবিধা পাওয়ার যোগ্যতা হারাবে বাংলাদেশ।

বিশেষ করে বাণিজ্য, উন্নয়ন সহায়তা, জলবায়ু পরিবর্তন সহায়তা, ভ্রমণ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা আর পাবে না দেশটি।
তবে অর্থনীতিবিদরা আশাবাদী। তারা বলছেন, বাংলাদেশের স্থিতিশীল অগ্রগতি ও প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এছাড়া কিছু বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে দরকষাকষি করতে পারে দেশটি। সামনেই রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা থাকলেও, শেষ অবদি স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বের হতে বাংলাদেশের সমস্যা হবে না। কিন্তু সমস্যা শুরু হতে পারে এর পর থেকে।
২৩ শে মার্চ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাতারে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করে। মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানবসম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক মূল্যমান সূচকে নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করার পর দেশটিকে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সাল থেকেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কাতারে রয়েছে। এই কাতারে থাকা আরও দুই দেশ মিয়ানমার ও লাওসও উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে।
১৯৭১ সালে মোট ১৭টি দেশকে স্বল্পোন্নত দেশের স্বীকৃতি দিয়েছিল জাতিসংঘ। বর্তমানে এই কাতারে দেশ আছে ৪৭টি। এখান থেকে মাত্র ৫টি দেশ এখন পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশ হতে পেরেছে। ১৯৯৪ সালে বোতসোয়ানা, ২০০৭ সালে কেপ ভার্ডে, ২০১১ সালে মালদ্বীপ, ২০১৪ সালে সামোয়া ও গত বছর ইকুয়েতোরিয়াল গিনি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়।
প্রতি তিন বছর পর পর জাতিসংঘের একটি কমিটি স্বল্পোন্নত দেশগুলোর তালিকা পর্যালোচনা করে। পর্যালোচনার ভিত্তিতে এই কমিটি কোনো দেশকে তালিকায় অন্তর্ভূক্তকরণ বা অন্য কাতারে উত্তরণের সুপারিশ করে থাকে। এর আগে ২০১৫ সালে এই কমিটি নেপাল ও ভুটান সহ তিনটি দেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে বলে স্বীকৃতি দেয়।
তিন বছরের উত্তরণ প্রক্রিয়ার পর ২০২১ সালে বাংলাদেশের অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে জাতিসংঘের ওই কমিটি। আগামী ছয় বছরে যদি তিন খাতেই (মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানব সম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক মূল্যমান সূচক) বাংলাদেশ অগ্রগতি ধরে রাখতে পারে, তবেই ২০২৪ সালে দেশটিকে চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেটি উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় তিন সীমারেখা একসঙ্গে অতিক্রম করেছে। তিনি বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কাতার থেকে সফলভাবে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে আমাদেরকে এখনও দুইটি পর্যালোচনা অতিক্রম করতে হবে। একটি ২০২১ সালে ও পরেরটি ২০২৪ সালে।’
বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ বলতে এই অর্থনীতিবিদ সবার প্রথমে অবকাঠামোর অভাবকে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি বড় অবকাঠামো প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তবে এই প্রকল্পগুলোর অগ্রগতির গতি বেশ শ্লথ। এই গতি বাড়াতে হবে।’ তার মতে, বাংলাদেশের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো বিদ্যমান নিয়মনীতির বেড়াজাল। তিনি মনে করেন, এ কারণেই বাংলাদেশে ব্যবসা করার ব্যয় অপ্রয়োজনীয়ভাবে অনেক বেশি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের তৃতীয় চ্যালেঞ্জ মানবসম্পদ উন্নয়ন। তার ভাষ্য, ‘আমাদের বিপুল তরুণ শ্রমশক্তি আছে। কিন্তু তাদের দক্ষতা ও শিক্ষার অভাব আছে। এটি অব্যাহত থাকলে, বাংলাদেশের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
অর্থনীতিবিদ মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবেই কোনো বিপত্তির মুখে পড়বে না। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ হওয়ায়, বাংলাদেশের কিছু স্কোর অর্জনে সমস্যা পোহাতে হতে পারে।’ তবে নির্ধারিত সময়ের পরও স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের রয়ে যাওয়ার কোনো ঝুঁকি তিনি দেখেন না।
বাংলাদেশের প্রথম সারির থিংকট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কাতার থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ প্রতি বছর ২৭০ কোটি ডলার মূল্যের রপ্তানি আয় হারাতে পারে।
তিনি যুক্তি দেখিয়ে বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে ৪০টিরও বেশি দেশের বাজারে বিভিন্ন মাত্রায় অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পায়। তার ভাষ্য, ‘বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বের হওয়া মাত্রই বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য অতিরিক্ত ৬.৭ শতাংশ শুল্কের মুখে পড়বে।’ এই ঝুঁকি এড়াতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও বাজার বৈচিত্রতা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের রপ্তানির প্রায় পুরোভাগ হলো তৈরি পোশাক। এই ধরণের অর্থনীতির জন্য উন্নয়নশীল তকমা অর্জন ভালো নয়।’
এই অর্থনীতিবিদের পরামর্শ, বাংলাদেশের উচিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির দিকে মনোযোগী হওয়া, যাতে করে কিছু বাজারে প্রবেশাধিকার পাওয়া যায়। সম্ভাব্য এমন বাজার হতে পারে চীন, তুরস্ক, ভিয়েতনাম ও ভারত।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, কাঙ্খিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হার অর্জনে বাংলাদেশের সামাজিক অবকাঠামোর সামর্থ্য বৃদ্ধি করা খুবই জরুরী।
তিনি বলেন, ‘অন্যথায় বাংলাদেশ মধ্যম-আয়ের ফাঁদে আটকে যেতে পারে। এই ফাঁদে বেশ কয়েকটি নি¤œ-মধ্যম আয়ের দেশ আটকে আছে। উপরে উঠতে পারছে না।’ তিনি আরও যোগ করেন, প্রয়োজনীয় মানব সম্পদ উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের বর্তমান অবস্থা মোটেই সন্তোষজনক নয়। তিনি বলেন, ‘এই খাতগুলোতে গড়পড়তা অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) অনেকগুলোই অর্জন করতে পারবে না।’ তবে সেলিম রায়হান মনে করেন, ২০২৪ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ উত্তরন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে পারবে।
সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিরতা কি এই উত্তরন প্রক্রিয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে? তার উত্তর, ‘আমি এই প্রক্রিয়ায় খুব বেশি অনিশ্চয়তা দেখি না। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অগ্রগতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সরকার পরিবর্তন হলেও দেশের উন্নয়ন গতিপথে তেমন পরিবর্তন আনে না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *