রাগে-দুঃখে চোখে পানি চলে আসছিল। তাকে এতটুকু প্রশ্রয় না দিয়ে দু’হাতে দ্রুত মুছে ফেলছিলেন অষ্টাদশী মেয়ে। ক্ষোভে ফুটতে ফুটতে কখনও কথা দিয়ে আঘাত করছিলেন প্রেসিডেন্টকে, কখনো বা মার্কিন জনপ্রতিনিধিদের। আর তার সুরে সুর মেলাচ্ছিলেন বড়রাও।
অস্ত্র আইনে রাশ না টানা, ন্যাশনাল রাইফ্ল অ্যাসোসিয়েশন-(এনআরএ)-এর কাছ থেকে দানখয়রাতি হাত পেতে নেয়া— সব বিষয়েই নেতাদের চোখা চোখা শব্দে আক্রমণ করেছেন হাইস্কুলের ছাত্রী এমা গঞ্জালেস। শনিবার ফ্লরিডার ফোর্ট লডেরডেল-এ মারজরি স্টোনম্যান ডগলাস স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অস্ত্রে নিষেধাজ্ঞার ডাক দিয়ে এক সভা করে। যে সব মার্কিন জনপ্রতিনিধি অস্ত্রে নিষেধ সমর্থন করেন না বা যারা এনআরএ-র কাছ থেকে টাকা নেন— তাদের ক্ষমতা থেকে সরানোর দাবি তুলেছে শিক্ষার্থীরা।
এত প্রাণহানি সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র আইন নিয়ে টুঁ শব্দ শোনা যায় না মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখে। একটা করে হামলা হয়। আর তিনি নীরব। দোষ দেন বন্দুকবাজদের মানসিক সমস্যাকে। এমার বক্তৃতার ঝাঁঝ তাই পরোয়া করেনি প্রেসিডেন্টকেও। জোরালো গলায় সে বলেছে, ‘‘যদি প্রেসিডেন্ট আমার কাছে এসে মুখের উপরে বলেন, যে এটা মর্মান্তিক ঘটনা ছিল… কিন্তু এটা নিয়ে তেমন কিছুই করার নেই… তা হলে খুব হাসিহাসি মুখে আমি তাকে জিজ্ঞেস করব, এনআরএ-র কাছ থেকে কত টাকা পেয়েছেন উনি? যদিও সংখ্যাটা আমি জানি। তিন কোটি ডলার! যে নেতাই এনআরএ-র কাছ থেকে টাকা নেন, তার লজ্জা হওয়া উচিত।’’ তার আশপাশে সবাই বলে ওঠেন, ‘‘শেম অন ইউ!’’
স্টোনম্যান স্কুলে ১৪ বছরের মেয়ে অ্যালিসাকে হারিয়ে মা লোরি আলহাডেফ দিন দুই আগে এমার মতোই প্রেসিডেন্টকে সক্রিয় হয়ে কিছু করার আর্জি জানিয়েছিলেন। এ বার সরব হলো শিক্ষার্থীরাও। অস্ত্র আইনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন এমা। সে দিন স্কুলে অডিটোরিয়ামে ঢুকে প্রাণ বেঁচেছে তার। বক্তৃতায় বলেছেন ‘‘কিছুতেই বুঝতে পারি না সপ্তাহান্তে বন্দুক কেনার চেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মজা করাটা কি এত কঠিন?’’
এমার সাফ কথা, ‘‘বড়রা হয়তো এটা বলতেই অভ্যস্ত যে, এ সব হতেই থাকবে। কিন্তু আমরা, শিক্ষার্থীরা শিখেছি পড়াশোনা না করলে ব্যর্থ হতে হয়। এ ক্ষেত্রে যদি তুমি সক্রিয় ভাবে কিছু না কর, মানুষ মরতেই থাকবে।’’ স্কুলের শৌচাগারে লুকিয়ে বেঁচে যান রায়ান ডিচ। অস্ত্র আইনে নিয়ন্ত্রণ চেয়ে তার দাবি, ‘‘আইনসভার প্রতিনিধিরা ভোট দিন। আর কত খারাপ হবে?’’
ট্রাম্প অবশ্য বিতর্কে কান দিচ্ছেন না। এফবিআইকে দুষে তার টুইট, ‘‘দুঃখজনক ব্যাপার। এফবিআই ফ্লরিডার স্কুলের বন্দুকবাজকে নিয়ে সব তথ্য অবহেলা করেছে। ট্রাম্প শিবিরের সঙ্গে রুশ যোগাযোগের প্রমাণ খুঁজতেই ব্যস্ত ওরা। নিজেদের দায়িত্বটা ঠিক করে পালন করুন।’’ গোয়েন্দা সূত্রে খবর, মৃত্যুদণ্ড এড়াতে দোষ কবুল করে ক্ষমা চাইতে পারে বন্দুকবাজ নিকোলাস ক্রুজ।
বিপজ্জনক ক্রুজ, জানত এফবিআই
ভুলের খেসারত ১৭টি প্রাণ! মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই স্বীকার করেছে, পার্কল্যান্ডে স্টোনম্যান স্কুলের বন্দুকবাজ নিকোলাস ক্রুজ যে বিপজ্জনক, তাদের হাতে এক মাস আগেই সে তথ্য এসেছিল। এটা এফবিআইয়েরই ব্যর্থতা যে তারা তখনই সক্রিয় হয়নি। বিপর্যয় তা হলে হয়তো বা এড়ানো যেত। পাশাপাশি নিজের পুরনো স্কুলে ঢুকে হত্যাকাণ্ড চালানোর কথা তদন্তকারীদের কাছে কবুল করেছে ১৯ বছরের ঘাতক নিকোলাস ক্রুজও।
আমেরিকায় কখনো স্কুলে, কখনো শপিং মলে, কখনো বা নাইটক্লাবে বিভিন্ন সময়ে একের পর এক বন্দুকবাজের হামলা কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। তা সত্ত্বেও আত্মরক্ষার নামে বন্দুক রাখার যে আইন নাগরিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে তৈরি হয়েছে, তা-ই এখন চরম দুশ্চিন্তার কারণ আম মার্কিনদের কাছে। প্রতিবারের মতো এ বারও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, এই হামলার পিছনে মূল কারণ ঘাতকের মানসিক সমস্যা। টেক্সাসের গির্জায় হামলার সময়েও যা বলেছিলেন, এ বারও সেই সুর। বন্দুক আইনে নিয়ন্ত্রণ আনার ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে নারাজ তিনি। স্টোনম্যান স্কুলে গুলিচালনার ঘটনার পরে তিনি এক টেলিভিশন বার্তায় সরাসরি শিশুদের উদ্দেশে কথা বলেন।
ট্রাম্পের বক্তব্য, ‘‘আমেরিকার সব বাচ্চাকে বলছি, কখনো ভাববে না তোমরা একা। আমরা তোমাদের ভালবাসি। তোমাদের সুরক্ষার জন্য যা দরকার, আমরা করব। সাহায্য লাগলে শিক্ষকের কাছে যাও, বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বল, বা পুলিশকে জানাও।’’ স্কুলে নিরাপত্তা বাড়াতে আরও কিছু নীতির কথা ভাবা হবে বলেও জানান তিনি। পার্কল্যান্ডের ওই স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে ট্রাম্পের। কিন্তু প্রেসিডেন্টের আশ্বাসে সন্তুষ্ট নন লোরি আলহাডেফ। স্টোনম্যান স্কুলের ছাত্র ১৪ বছরের মেয়ে অ্যালিসাকে হারিয়ে ক্ষুব্ধ মা বলছেন, ‘‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, প্লিজ কিছু করুন। কাজ দরকার। এখনই। বাচ্চাগুলোকে সুরক্ষা দিতে হবে।’’ নিরাপত্তারক্ষী থাকা সত্ত্বেও এক জন বন্দুক নিয়ে ঢুকে গেল বাচ্চাদের স্কুলে, প্রশ্ন তাঁর। সরাসরি ট্রাম্পকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে লোরি বলছেন, ‘‘বাচ্চাদের হাতে যাতে বন্দুক না ওঠে, সেটা অন্তত দেখুন। আপনি অনেক কিছুই করতে পারেন। শিশুদের সঙ্গে এই অন্যায় চলতে পারে না।’’
ক্রুজ তদন্তকারীদের জানিয়েছে, সে উবের নিয়ে দুপুর দু’টো কুড়ি মিনিটে স্কুলে পৌঁছয়। তার তিন মিনিটের মধ্যেই একের পর এক ক্লাসরুমে গুলি চালাতে শুরু করে। হত্যাকাণ্ড চালিয়ে এক বার ওয়াল মার্ট এবং তার পরে ম্যাকডোনাল্ডস-এ কিছু ক্ষণ কাটায় সে। ঘটনার চল্লিশ মিনিটের মাথায় পুলিশ তাকে ধরে। গত বছর সেপ্টেম্বরে তার ইউটিউব পোস্টে লেখা ছিল, ‘‘আমি পেশাদার স্কুল শ্যুটার হতে চাই।’’ এই বার্তাও এফবিআইয়ের হাতে এসেছিল। কিন্তু সংস্থার দাবি, তারা নেট দুনিয়া যথেষ্ট ঘেঁটেও তখন চিহ্নিত করতে পারেনি এই পোস্টের পিছনে কে রয়েছে।