লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছে আ’লীগ

Slider রাজনীতি

279632_11

 

 

 

 

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ার পর লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনী রাজনীতিতে বিষয়টির কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে ক্ষমতাসীন দলে। রায়ের পর সারা দেশে মানুষের প্রতিক্রিয়া বোঝারও চেষ্টা করা হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে। টিভি টকশোতে বিতর্ক, দর্শকদের প্রশ্নের ধরন এবং ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনগণের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে গোয়েন্দা শাখা থেকেও। গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বিদেশী রাষ্ট্র ও দাতা সংস্থাদের।

আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, দুর্নীতির অভিযোগে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শাস্তি হোক তা মনেপ্রাণে চেয়েছে ক্ষমতাসীনেরা- যাতে আগামী নির্বাচনে এ ইস্যুটি কাজে লাগানো যায়। সেজন্য গত বৃহস্পতিবার রায়ের পরপরই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আনন্দমিছিল, ভূরিভোজ ও মিষ্টি বিতরণ করেছে সরকার সমর্থকেরা। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ওই দিনই বরিশালে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জ্বালাও পোড়াও করলে শাস্তি পেতে হয়। এতিমের টাকা মেরে তিনি এখন কোথায়! তার লজ্জা থাকলে আর এতিমের টাকা মেরে খাবেন না।’

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে জাতীয় সংসদেও। রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রীরা রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে খালেদা জিয়ার কঠোর সমালোচনা করেন।
খালেদা জিয়ার সাজা আগামী নির্বাচনে সরকারের জন্য ইতিবাচক হবে বলে মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ। তাদের মতে, এ রায় আওয়ামী লীগকে নির্বাচনী প্রচারে এক ধাপ এগিয়ে রাখবে। বিএনপির শীর্ষ নেতারা ‘দুর্নীতিবাজ’, তারা আদালতেও দণ্ডিত হয়েছেন। তারা মনে করেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশের ইমেজকে বিশ্বে একটি উচ্চতর আসনে নিয়ে গেছেন তখন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে বন্দী। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দেশ আবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হবে বিষয়টি এমনভাবে তুলে ধরে ব্যাপকভাবে প্রচারের সুযোগ পাবে ক্ষমতাসীনেরা। এ ছাড়া খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলে বিএনপি ভাঙনেরও সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সে জন্য ক্ষমতাসীন দলে খুশির আমেজ বইছে।

অন্য দিকে দুই কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগে দেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হওয়ায় কিছুটা উদ্বেগ এবং অস্বস্তিও রয়েছে সরকারি দলে। রায়ের পর বিএনপির সংযত ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, সাধারণ মানুষের অভিব্যক্তি, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া এবং টিভি টকশোতে বিশ্লেষণ ও দর্শকদের প্রশ্নের ধরন নিয়ে কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে সরকার। এসব মাধ্যমে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায়ের পাশাপাশি এ সরকারের আমলে সোনালী, জনতা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের বিষয়টিও সামনে চলে আসছে। সামনে চলে আসছে রাষ্ট্রীয় টাকায় টিআর কাবিখার জন্য পচা গম আমদানিসহ সরকারের নানা বিতর্কিত ইস্যু। যা নিয়ে বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা।

রাজনীতি বিশ্লেষকেরাও দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার দণ্ডিত হওয়াকে বিএনপির জন্য শাপে বর হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, রায়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপির যে সংযত প্রতিক্রিয়া তা রাজনীতিতে অনেকটা নজির হয়ে থাকবে। জ্বালাও-পোড়াও বা হরতাল-অবরোধে না গিয়ে বিএনপির এমন ইতিবাচক আচরণে ‘পাবলিক সেন্টিমেন্ট’ তাদের পক্ষেই যাবে। হয়তো সরকারও চেয়েছে দলের শীর্ষ নেতাকে কারাগারে নেয়া হলে বিএনপি জ্বলে উঠবে। বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়াবে। আর সরকারও তাদের বিরুদ্ধে মামলাসহ আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে। কিন্তু খালেদা জিয়ার নির্দেশনা মেনে বিএনপি নেতাকর্মীরা তাদের সেই ফাঁদে হয়তো পা দেয়নি। এটা জনগণ খুব ইতিবাচকভাবে নিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ ড. আনোয়ার হোসেন বলেছেন, বিএনপির জন্য সঙ্কট হচ্ছে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা তো একটা নয়, অনেক মামলা আছে। আর এই মামলা তো রায়ের সূচনা মাত্র। রায়ের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে আপিল করবে। সেখানে কত দিন লাগে সেটাও সামলানোর ব্যাপার আছে। রায় সামলাতে হবে, মামলা সামলাতে হবে, নির্বাচন সামলাতে হবে। এক সাথে সবগুলো কাজ বিএনপিকে করতে হবে। তবে এই রায়ে বিএনপির জন্য নেতিবাচক ফলাফলের চেয়ে অনেক ইতিবাচক দিক বেরিয়ে আসবে। আর আওয়ামী লীগের জন্য নিজের ঘর সামলানো কঠিন হয়ে যাবে।

এই ইতিহাসবিদের মতে, ‘দুর্নীতি তো সবসময়ই ছিল। পাকিস্তান আমলে ছিল, বাংলাদেশ হওয়ার পরই শুরু হলো। গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে। আর সম্প্রতি জনতা ব্যাংকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা কেলেঙ্কারি হয়েছে। এখানেও এক ব্যক্তি এক পরিবার। কই সেগুলোর তো কিছু হয়নি। মাঝে মধ্যে দু-চারটা মামলা এদিক সেদিক হয় যা আমরা কাগজে পড়ি। কিন্তু পরে তা কই হারিয়ে যায় তা জানি না।’

সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হচ্ছে, সেখানে দুই কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়ে বেশি উল্লসিত হওয়ার কারণ নেই। তবে এই রায়টি একটি বার্তা, দুর্নীতি করলে ধরা পড়তে হবে সে যে হোক। এ জন্য আমি আদালতকে ধন্যবাদ জানাই। তবে সরকারকে বলব, দুর্নীতির রাঘব বোয়ালদের ধরতে হবে। ছোট একটি দুর্নীতি মামলার রায় নিয়ে বেশি তুষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই।’

তিনি আরো বলেন, ‘মাঝে মাঝে কাগজে পড়ি হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন আছে; কিন্তু এই দুর্নীতি দমন কমিশন যখন বিশেষ কোনো ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করে তখন ভূমিকা পালন করে। আমি মনে করি দুদকের সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নজর দেয়া উচিত।’

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, রাজনীতিবিদদের জন্য কারাবরণ একটি আশীর্বাদ। সেজন্য এই বয়সে এসেও খালেদা জিয়ার কারাবরণ তার জনপ্রিয়তাকে বাড়িয়ে দিতে পারে। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে আগামী জাতীয় নির্বাচনে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডের পর আওয়ামী লীগ উল্লসিত হলেও বিষয়টি নিয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা চিন্তিত সরকার। নির্বাচনের বছরে এমন রায়ের পর জাতিসঙ্ঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো নজরদারি বাড়িয়েছে। এ রায়ের পর বিএনপির রাজনৈতিক কৌশলের কারণে সরকার তাদের কাবু করতে পারেনি। রায় নিয়ে মাতামাতি না করতে ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের নেতাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, ‘রায় দিয়েছে আদালত। এখানে সরকারের কিছু করার নেই। বিএনপি সেটা আদলতেই বুঝবে।’ দলের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ‘রাজনৈতিক নেতাদের জন্য কারাবাস কোনো বিষয় নয়। কারাবরণ ছাড়া রাজনীতিক হওয়া যায় না’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুই নেতা বলেন, ‘খালেদা জিয়া ও তার ছেলে দুর্নীতিবাজ এ কথা প্রমাণ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু মনে হচ্ছে এ রায় তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে। আর বিএনপি কোনো ধরনের জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচিতে না গিয়ে খুব রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছে।’

দলের সম্পাদকমণ্ডলীর তিন নেতার মতে, সারা দেশে কারফিউয়ের মতো অবস্থার মধ্যেও কয়েক মিনিটের ব্যবধানে বিএনপি রাজধানীতে যে শোডাউন দিয়েছে এতে তাদের রাজনৈতিক সক্ষমতার পরিচয় পাওয়া গেল। তারা ইচ্ছা করলে সহিংস কর্মকাণ্ড করতে পারত। কিন্তু তা না করে সংযত অবস্থানে ছিল। জনগণও বিষয়টি খুব ভালোভাবে নিয়েছে। যার ফল বিএনপিই ঘরে তুলবে।

এক নেতা রসিকতা বসে বলেন, ‘আসলেই এ রায় রাজনীতিকদের জন্য সতর্কবার্তা। কখনো ক্ষমতার পালাবদল হলে সরকারের ভেতরে দুর্নীতির অভিযোগ থাকা কোনো কোনো নেতারও এমন পরিণতি হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *