এম আরমান খান জয়,মধুমতি থেকে ফিরে :
হায়রে আমার মন মাতানো দেশ হায়রে আমার সোনা ফলা মাটি রূপ দেখে তোর কেন আমার নয়ন ভরে না।
“মধুমতী” বাংলার অসংখ্য নদীর মাঝে একটি। একটা সময় ছিল বাংলার ঘাস বুক মাটিকে জড়িয়ে ছিল অগুনতি নদী। শাখা নদী, উপ নদী আর নদেরা মিলিয়ে বিশাল নদী পরিবারের ছিল জালের মতো বিস্তার। আজ এই সময়ে শুকিয়ে গেছে অনেক খর¯্রােতা দস্যি নদীরা। মানুষের দখল, মাটি ভরাট, আবর্জনা নিক্ষেপের মতো আত্মঘাতী কাজগুলো নদীকে হত্যা করেছে। জলাবদ্ধতায় নগরীর আজকের এই বিলাপ তো নদীর সেই মৃত্যুরই ফল!
এরই মাঝে এখনো বঙ্গদেশকে শ্যামল রেখেছে কিছু অপূর্ব নদী। মধুমতী তাদের একটি। এই নদীকে দেখে সত্যিই মন গেয়ে ওঠে-
….এই মধুমতী ধানসিঁড়ী নদীর তীরে
নিজেকে হারিয়ে যেন পাই ফিরে ফিরে ।
মধুমতি আর ঘাগোর নদীর তীরে এবং হাওড়-বাঁওড়ের মিলনে গড়ে ওঠা বাংলার অবারিত প্রাকৃতিক পরিবেশে টুঙ্গিপাড়া গ্রামটি অবস্থিত। আজ থেকে ছয়’শ বছর আগে কবিরতœ বিজয় গুপ্ত তাঁর পদ্মাপুরাণ কাব্যে এই ঘাগোর নদীর ঐতিহাসিক বর্ণনা দিয়ে গেছেন। টুঙ্গিপাড়া গ্রামের সারি সারি গাছগুলো ছিল ছবির মতো সাজানো। নদীতে তখন বড় বড় পালতোলা পানশি, কেরায়া নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার চলতো। বর্ষায় গ্রামটিকে মনে হতো যেন শিল্পীর আঁকা জলে ডোবা একখন্ড ছবি।
কিছু দিন আগে শত ব্যস্ততার মাঝেও সময় বেড় করে আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর শৈশবের দূরন্ত স্মৃতিমাখা এই নদীর তীরে।
মধুমতী নদীর উপর নির্মিত হয়েছে পাটগাতী সেতু।
চাইলে গোপালগঞ্জের বাসে আপনিও বেড়িয়ে আসতে পারেন খুব সহজেই। বাস ভাড়াও কম। বাস স্ট্যান্ডে নেমেই একটা লোকাল অটোতে উঠে যাবেন। অটো আপনাকে নিয়ে যাবে পাটগাতি সেতুর ওপর। হেঁটেও যেতে পারবেন, দূরত্ব খুব বেশি নয়। ব্রিজ থেকে উপভোগ করা যায় বিস্তৃত নদীটির অপরূপ দৃশ্যাবলী। নদীর উপর বিশাল আকাশ, আকাশে মেঘের খেলা সবই মুগ্ধ করবে আপনাকে। কিন্তু আমরা নদীটিকে আরও কাছ থেকে উপভোগ করতে চাইছিলাম। তাই নেমে গেলাম ব্রিজের পাশ দিয়ে একেবারে তীরে। মধুমতী সেতুর উপর থেকে দেখা বিস্তৃত মধুমতী।
দু’পাশে সবুজ গ্রাম, ফসলী জমি, কোনো কোলাহল নেই। সত্যিই চোখ জুড়ানো শান্তির জন্য আর কিছু লাগে না! পাখি উড়ছে, নৌকা চলছে, গরু চড়িয়ে রাখাল কোথায় গেছে কে জানে! সবদিকে একটা অদ্ভুত শান্তি মাখানো। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে দ্রুত গতির ট্রলারের ইঞ্জিনের শব্দ নিরবতায় একটু ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল বটে! তবু শহরের যান্ত্রিক তান্ডবের সাথে এর কোনো তুলনাই চলে না। নদীর তীরে বাঁধা আছে নৌকা। দল বল নিয়ে এসে বেড়াতে পারবেন ইচ্ছেমতো।
গোপালগঞ্জে মধুমতী ছাড়াও দু’চোখ ভরে উপভোগ করতে যেতে পারেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে অবশ্যই যাবেন। শেখ রাসেল পার্কও বর্তমানে এই অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় অবকাশ যাপন স্থলে পরিণত হয়েছে। ঘুরে আসতে পারেন সেখানেও। সব মিলিয়ে মধুমতী এমন দৃশ্যের কাছে হার মানে জাগতিক সব চাহিদা।
ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল, বিলম্বে হলেও সরকার কি মধুমতি নদী উদ্ধার, সংস্কার ও সংরক্ষণে উদ্যোগী হতে পারে না? বিশ্বের অনেক নেতার জন্মভূমিতেই প্রাকৃতিক নদী বা জলাশয় নেই। সৌন্দর্য ও স্নিগ্ধতার জন্য কৃত্রিম উপায়ে জলাশয় তৈরি করা হয় সেক্ষেত্রে। আর টুঙ্গিপাড়া কেবল বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমি নয়, শেষ নিদ্রাস্থলও। কেবল প্রকৃতি নিজেই সেখানে একটি নয়নাভিরাম নদী দেয়নি, ওই নদীতে জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোরের অমূল্য স্মৃতি। কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হলে জাতির জনকের স্মৃতিময় সেই নদী সংস্কার ও সংরক্ষণ কোনো কঠিন কাজ হতে পারে না।