ডাকাতি মামলার আসামির সঙ্গে নামের মিল। বাবার নামও একই। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা ভিন্ন। তবে নামের মিল থাকার খেসারত দিতে হলো কুমিল্লার লেপ-তোশকের দোকানি মো. ইউনুছকে (৫৫)। পুলিশের ভুলে বিনা দোষে কারাভোগ করলেন ৫৮ দিন। অবশেষে আদালতের নির্দেশে মুক্তি পেলেন গত বৃহস্পতিবার। চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার একটি ডাকাতির মামলায় গত বছরের ৮ নভেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকে কথা হয় ইউনুছের সঙ্গে। পরনে লুঙ্গি ও সাদা শার্ট। মুখে সাদা দাড়ি। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। বললেন, ‘কী দোষ করেছিলাম। এর আগে কোনো দিন চট্টগ্রাম শহরেই আসিনি। অথচ এখানকার ডাকাতি মামলায় হাতকড়া পরতে হলো আমাকে।’ তিনি বলেন, পুলিশকে বারবার বলা হয়েছিল তাঁর নামে কোনো মামলা নেই। কিন্তু পুলিশ তা কানেও তোলেনি।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০০ সালের ১৬ জুলাই নগরের কোতোয়ালি থানার লালদীঘির পাড় এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়। তদন্ত শেষে পুলিশ ২০০২ সালের ২২ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এতে মো. ইউনুছসহ (প্রকৃত আসামি) চারজনকে আসামি করা হয়। ঘটনার পর পুলিশ ইউনুছকে গ্রেপ্তার করলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ২০০৩ সালে জামিনে গিয়ে পলাতক হয়ে যান তিনি। ইউনুছকে পুলিশ খুঁজে না পাওয়ায় সর্বশেষ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল চট্টগ্রামের বিচারক আসামির বিরুদ্ধে গত বছরের ৩০ জুলাই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরোয়ানায় কুমিল্লার মুরাদনগর থানার যাত্রাপুর ইউনিয়নের বাদশা গাজীর ফকির বাড়ির রজব আলীর ছেলে মো. ইউনুছের নাম রয়েছে। পরোয়ানাটি পাওয়ার পর মুরাদনগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জালাল উদ্দিন গত ৮ নভেম্বর ইউনুছকে (নিরপরাধ) কোম্পানীগঞ্জ এলাকার দোকান থেকে গ্রেপ্তার করেন। এই ইউনুছের ঠিকানা যাত্রাপুরের মকবুল হাজি বাড়ি। গ্রেপ্তারের পর চার দিন তাঁকে কুমিল্লা কারাগারে রাখা হয়। সেখান থেকে পাঠানো হয় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে।
ইউনুছের আইনজীবী আবদুল মোবারক বলেন, আদালত পরোয়ানা জারির পর যে ইউনুছকে গ্রেপ্তার করেছে, সেই ইউনুছ প্রকৃত আসামি নন জানিয়ে মুক্তির আবেদন করা হয়। পরে আদালত মুরাদনগর থানার পুলিশকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য গত বছরের ২৯ নভেম্বর আদেশ দেন। ডিসেম্বর মাসে আদালত বন্ধ থাকায় জানুয়ারি মাসের শুরুতে থানা থেকে প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, গ্রেপ্তার ইউনুছ প্রকৃত আসামি নন। নামের মিল থাকায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার ইউনুছকে বাড়ি নিয়ে যেতে আসেন তাঁর বড় ছেলে মো. শরীফ ও ছোট ছেলে মো. সুমন। শরীফ বলেন, গত দুই মাস বাবা কারাগারে থাকায় তাঁদের দোকান বন্ধ ছিল। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে বাবার মুক্তির জন্য লড়েছেন।
অশ্রুসজল চোখে ইউনুছ বলেন, এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চান। তাঁর মতো নিরীহ আর কোনো মানুষকে যেন এভাবে বিনা বিচারে কারাভোগ করতে না হয়। আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, নিরীহ কাউকে কারাগারে আটক রাখা হলে সম্প্রতি হাইকোর্ট ক্ষতিগ্রস্তকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
জানতে চাইলে কুমিল্লার মুরাদনগর থানার এসআই জালাল উদ্দিন বলেন, নামের মিল থাকায় ভুলবশত ইউনুছকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রকৃত ইউনুছকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। ইচ্ছাকৃতভাবে এই ভুল হয়নি।
জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল চট্টগ্রামের সরকারি কৌঁসুলি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আদালত গত বুধবার নিরপরাধ ইউনুছকে মুক্তির নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে কুমিল্লা পুলিশ সুপারকে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও আদেশ দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার মো. শাহ আবিদ হোসেন গত বৃহস্পতিবার রাতে মুঠোফোনে বলেন, আদালতের আদেশটি হাতে পাওয়ায় পর জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।