দাবি না মানলে মরা ছাড়া গতি নেই

Slider শিক্ষা

284533_163

 

 

 

 

সরকার যদি আমাদের দাবির প্রতি সাড়া না দেয় তাহলে না খেয়ে মরে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় থাকবে না। এ ছাড়া আমরা আর কী করতে পারি? আমরা অনেক অহিংস আন্দোলন করেছি। বারবার খালি হাতে ফিরে গিয়েছি। এখন না খেয়ে মরা ছাড়া আমাদের আর কোনো গতি নেই।

কথাগুলো বললেন বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি কাজী রুহুল আমিন চৌধুরী।
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষকদের আমরণ অনশনের গতকাল চতুর্থ দিন পার হয়েছে। তাদের দাবি মাদরাসা বোর্ড থেকে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণ করতে হবে। কিন্তুসরকার এখনো নির্বিকার তাদের এ দাবির প্রতি। অপর দিকে অনশনরত শিক্ষকেরাও অনড় অবস্থান ব্যক্ত করে জানিয়েছেন, দাবি আদায় না করে তারা এবার আর বাড়ি ফিরবেন না। অনশন করতে করতে যদি মৃত্যুও হয় তবু তারা ফিরবেন না।

সমিতির সহসভাপতি তাজুল ইসলাম ফরাজী বলেন, আমরা আর এ মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাই না। আমাদের আর মুখ দেখানোর উপায় নেই। মানুষ এখন আমাদের নিয়ে মশকারা করে। তাই দাবি আদায় করার জন্য যত দিন অনশন করতে হয় করব। প্রয়োজনে মরে যাবো। কিন্তু এভাবে আর ফিরতে চাই না।

মাস্টার্স পাস করে বিনা বেতনে শিক্ষকতা
আব্দুল লতিফ চৌধুরী কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে মাস্টার্স পাস করেছেন। এ ছাড়া তিনি কুরআনে হাফেজ এবং মাদরাসা থেকে কামিল পাসও করেছেন। আব্দুল লতিফ চৌধুরী টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে অবস্থিত অলোয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসায় গত ২০ বছর ধরে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করছেন। তিনি মাদরাসার প্রধান শিক্ষক। মাস্টার্স পাস করে কেন এখানে পড়ে আছেন জানতে চাইলে আব্দুল লতিফ বলেন, মাদরাসাটি আমার নানা প্রতিষ্ঠা করেছেন। নানা মারা যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেছেন আমার পরে তুমি মাদরাসাটি চালাবে। এটা একটি দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। তুমি এটা ছেড়ে যাবে না। মাদরাসাটি ধরে রাখবে।
তাই নানার কথা অনুযায়ী পরকালের আশায় এখানে থেকে গেছি। কিভাবে সংসার চালান জানতে চাইলে আব্দুল লতিফ বলেন, কিছু জমি আছে। তা চাষ করি।

জাতীয়করণ বিষয়ে তিনি বলেন, যত দিন সরকার আমাদের দাবি না মানবে তত দিন এখানে অনশন করতে থাকব। একই দাবির কথা জানান জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার শিক্ষক মো: নাসির উদ্দিন। তিনি ৩৩ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন।

রুহুল আমিন সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার গাড়ামাসী স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক। তিনি কামিল পাসের সাথে সাধারণ শিক্ষায়ও মাস্টার্স পাস করেছেন ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে। ২৫ বছর ধরে তিনি বিনা বেতনে চাকরি করছেন।

মো: গোলাম মাওলা জামালপুর জেলার বকশিগঞ্জে অবস্থিত আইরমারি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসায় ৩০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। মাওলানা মো: শেখ আব্দুস সাত্তার কাউনিয়ার চর স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসায় ৩২ বছর ধরে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করেছেন। মাদরাসাটি ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শেখ আবদুস সাত্তার কামিল পাস করেছেন। দাবি আদায়ের ব্যাপারে তারা সবাই অনড় অবস্থানের কথা জানান।

অনশনে অংশ নেয়া সুলতান আহমেদ নামে একজন তরুণ শিক্ষক মুখ মলিন করে বলেন, ভাই আমি খুব গরিব মানুষ। না খেয়ে আর কত দিন থাকব। আর এভাবে খালি হাতে বাড়ি গিয়ে করবই বা কী? সংসার তো অচল। সুলতান আহমেদ নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার মৌজাতৈলমারি দক্ষিণ যদুনাথপাড়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক।
জাতীয়করণের দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলনের বিবরণ দিয়ে সমিতির সহভাপাতি তাজুল ইসলাম ফরাজী বলেন, ২০১৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে জাতীয়করণের লক্ষ্যে লাগাতার আন্দোলনের কর্মসূচি শুরু করি আমরা। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনেই আট থেকে ১০ বার অবস্থান কর্মসূচি, মানববন্ধনসহ অনেক কর্মসূচি পালন করেছি আমরা। ২০১৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে একটানা ২৯ দিন অবস্থান কর্মসূচি করে খালি হাতে ফেরত গিয়েছি। তখন শিক্ষামন্ত্রী আমাদের ডেকে নিয়ে বৈঠকও করেছেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। দীর্ঘ আন্দোলনের সময় মন্ত্রীসহ শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে অনেক বৈঠক হয়েছে, কমিটি গঠিত হয়েছে আমাদের দাবি পূরণের বিষয়ে। কিন্তু প্রতিবার ফলাফল শূন্য। এখন আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। দাবি আদায় না করে ফেরার কোনো সুযোগ নেই।

গত ১ জানুয়ারি থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির গত ৯ জানুয়ারি থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন তারা। অনশনে প্রতিদিন বাড়ছে শিক্ষকদের সংখ্যা। সমিতির সভাপতি কাজী রুহুল আমিন চৌধুরী বলেন, একটানা ১২ দিন অবস্থান এবং চার দিন অনশনের কারণে এখন সবাই কমবেশি অসুস্থ। আমরা স্বাস্থ্যসচিবের কাছে চিঠি লিখেছিলাম আমাদের চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়ার জন্য। কিন্তু কোনো সাড়া পেলাম না। তিনি বলেন, আমরা শিক্ষামন্ত্রীর অধীন হলেও শিক্ষামন্ত্রী এখন পর্যন্ত আমাদের কোনো খোঁজ নিলেন না।

অনশন কর্মসূচিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালনরত তরুণ শিক্ষক আবু সাঈদ জানান, গতকাল পর্যন্ত শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষিকা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। সাতজনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

শিক্ষকেরা জানান, ১৯৯৪ সালে একই পরিপত্রে রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা ভাতার আওতায় আনার ঘোষণা দেয়ার পর সব রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করা হয়, কিন্তু স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণ করা হয়নি। জাতীয়করণ দূরের কথা, মাত্র এক হাজার ৫১৯টি মাদরাসা ভাতার আওতায় আনার পর এ সংক্রান্ত কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। অপর দিকে রেজিস্টার্ড প্রাইমরি স্কুলের ভাতা ধাপে ধাপে বাড়ার পর ২০১৩ সালে সব স্কুল জাতীয়করণ করা হয়।

১৯৮৪ সালে মাদরাসা বোর্ড ১৮ হাজার ১৯৪টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা রেজিস্ট্রেশন দেয়। বেতন ভাতার অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক মাদরাসা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *