রংপুর: সিটি করপোরেশন আওয়ামী লীগের কাছে কৌশলের নির্বাচন। এতে জিতলেও লাভ, হারলেও লাভ। বরং জাতীয় পার্টির প্রার্থী জিতলে সরকারি দলের দুই কূল রক্ষা হয়। একদিকে মহাজোটের শরিককে খুশি করা যাবে, অন্যদিকে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপি প্রশ্ন তুলতে পারবে না। বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, সেটাও দেখানো যাবে। এ জন্য অন্যান্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো রংপুর নিয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ মরিয়া হয়ে মাঠে নামছে না।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র বলছে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটের মাঠে বিএনপির অবস্থা সম্পর্কেও সরকার একটা ধারণা পাবে; যা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কৌশল ঠিক করার ক্ষেত্রেও কাজে লাগবে।
আবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে মনে করছেন, রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদটি মহাজোটের শরিক এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টির জন্য আওয়ামী লীগের ‘উপহার’। জাতীয় পার্টিতেও এমন ধারণা তৈরি হয়েছে বলে দলটির উচ্চপর্যায়ের একজন নেতা জানিয়েছেন।
গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তাঁরা চান রংপুরে সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে সার্বিক সহযোগিতা করবে সরকার। তিনি ঢাকার উত্তর সিটি নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, তাঁরা জরিপ করে সে ফল অনুযায়ী এখানে প্রার্থী ঠিক করবেন।
সরকারি দলের উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে তৎপরতা চালানোর যে রীতি আগে থেকেই আছে, তা রংপুরের বেলায় অনেকটাই অনুপস্থিত। রংপুরে প্রার্থীর নিজস্ব জনপ্রিয়তা ও স্থানীয় সাংগঠনিক শক্তির ওপরই বেশি নির্ভর করা হচ্ছে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত তাঁদের অভ্যন্তরীণ যে মূল্যায়ন, তাতে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থীর চেয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর অবস্থা ভালো। এ অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ কিংবা কুমিল্লা সিটির মতো এখানে দলীয় প্রার্থীর জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে দৌড়ঝাঁপ কম।
এখন পর্যন্ত রংপুর সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারের জন্য যাঁরা গেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আফজাল হোসেন, যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী প্রমুখ। অন্যদিকে নির্বাচনী আচরণবিধির কারণে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ জনসংযোগ না করলেও ভেতরে ভেতরে তিনি সবকিছু দেখাশোনা করছেন। তাঁর ভাই ও দলের কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদেরসহ দলটির অন্য শীর্ষ নেতারা মাঠে সক্রিয় আছেন। রংপুরের জন্য জাতীয় পার্টির আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান (রাঙ্গা) সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন। বিএনপির প্রার্থীর জন্য দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ একাধিক শীর্ষ নেতা প্রচার চালাচ্ছেন।
রংপুরে মেয়র পদে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান ও বিএনপির প্রার্থী কাওছার রহমান। এর বাইরে আরও চারজন মেয়র প্রার্থী থাকলেও তাঁরা মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেই বলে স্থানীয় ভোটাররা মনে করছেন। এবার এখানে দলীয় প্রতীকে ভোট হবে।
আওয়ামী লীগের দুজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী সদ্য সাবেক মেয়র শরফুদ্দীন (ঝন্টু) আগে জাতীয় পার্টির রাজনীতি করেছেন। এখনো আওয়ামী লীগে বড় কোনো পদ নেই। দলীয় পদধারী অনেকে মনোনয়ন চেয়ে পাননি। ফলে দলে বিভেদ আছে। কেন্দ্র থেকে তৎপরতা কম থাকার কারণে নেতা-কর্মীদের মাঝেও ভুল বার্তা গেছে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের তৎপরতাও ঢিলেঢালা। অনেকটা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ ধরনের।
অবশ্য আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ফারুক খান বলেন, এই নির্বাচনকে গুরুত্ব কম দেওয়া হচ্ছে, এটা ঠিক নয়। মন্ত্রী-সাংসদেরা আইনত যেতে পারেন না, তাই অন্যরা যাচ্ছেন। প্রার্থী যেভাবে সহায়তা চাচ্ছেন, সেভাবেই সহায়তা করা হচ্ছে। তাঁর দাবি, রংপুরে তাঁদের প্রার্থী পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন, উন্নয়ন করেছেন, ভোটারের কাছে জনপ্রিয়। তাই জয়ী না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
অবশ্য এর আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও মন্ত্রী-সাংসদেরা আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্রচারে অংশ নিয়েছেন, এমন নজির আছে। নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনিসহ মন্ত্রী-সাংসদ নন দলের এমন উচ্চ পর্যায়ের নেতারা দফায় দফায় সফর করেছেন, সেখানে অবস্থান করেছেন। অনেক মন্ত্রী-সাংসদ ভোট দেওয়ার ছুতোয় কিংবা নির্বাচনী এলাকার আশপাশে অবস্থান নিয়ে ভোটের প্রচার চালিয়েছেন। কিন্তু রংপুরে এখনো এমনটা দেখা যায়নি।
নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির প্রার্থীরা। নারায়ণগঞ্জে বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেনকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভী মেয়র নির্বাচিত হন। আর কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের আঞ্জুম সুলতানাকে পরাজিত করে বিএনপির মনিরুল হক পুনরায় মেয়র হন। রংপুরে জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে আওয়ামী লীগ।
বর্তমান জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের আসন জাতীয় পার্টির দখলে। একই সঙ্গে তারা সরকারেরও অংশ। অর্থাৎ ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে যে মহাজোট করেছিল আওয়ামী লীগ, এখনো রাজনীতির মাঠে এই ঐক্যের ফাটল ধরেনি। আর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের নিজ জেলা হচ্ছে রংপুর।
জাতীয় পার্টির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, জাতীয় পার্টির নির্বাচনী প্রতীক লাঙ্গল রংপুরে বরাবরই জনপ্রিয়, যা জাতীয় পার্টির প্রার্থীর জন্য বাড়তি সুবিধা। সামনে জাতীয় নির্বাচন। ফলে সরকারি সুবিধা কাজে লাগিয়ে জবরদস্তি করে রংপুর সিটিতে জিততে আগ্রহী নয় আওয়ামী লীগ। এতে জাতীয় পার্টির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার ঝুঁকি থাকছে। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
রংপুর সিটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রধান সমন্বয়ক, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান (রাঙ্গা) বলেন, এখন পর্যন্ত তাঁদের প্রার্থীর জয়ের ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত তাঁরা। জাতীয় পার্টির সঙ্গে কোন দলের প্রার্থীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, জানতে চাইলে মসিউর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যেকোনো প্রার্থীই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন। প্রতিদিনই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে।’