যুদ্ধজয়ের আনন্দ অতুলনীয়। আর সেই বিজয়ের ভেতর দিয়ে যদি অর্জিত হয় জাতীয় স্বাধীনতা, তবে সেই আনন্দ হয়ে ওঠে আরও অপরিসীম। বাঙালির জীবনে আজ সেই আনন্দের দিন। আজ থেকে ৪৬ বছর আগের এই কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের দিনে পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনী সম্মুখসমরে পরাজিত হয়ে হেঁট মস্তকে দাঁড়িয়ে ছিল বীর বাঙালির কাছে। আজ চিরগৌরবের মহান বিজয় দিবস। আজ লাল সবুজের উৎসবের দিন।
বিজয়ের এই দিনটি জাতির জীবনে একই সঙ্গে বেদনারও। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে বাঙালিকে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বাংলার পলি মাটি, রক্তিম হয়েছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার ধারা। সম্ভ্রম হারিয়েছেন তিন লাখ মা-বোন। অগণিত মানুষ নির্যাতিত হয়েছেন, সহ্য করছেন দুর্বিষহ যন্ত্রণা। হানাদার পাকিস্তানি সেনারা জ্বালিয়ে দিয়েছে অসংখ্য ঘরবাড়ি। সম্পদহানি হয়েছে বিপুল। আজ কৃতজ্ঞ জাতি গভীর বেদনা ও বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে স্বাধীনতার জন্য যে বীর সন্তানেরা আত্মদান করেছেন, যাঁরা জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাঁদের।
বাঙালির স্বাধীনতাসংগ্রামের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পথ ছিল সুদীর্ঘ। ২০০ বছর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। ব্রিটিশদের শাসন-শোষণের অবসান ঘটলেও বাঙালির শোষণমুক্তি ঘটেনি। পশ্চিম পাকিস্তানিরা শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালির ওপর শোষণ, দমন চালাতে থাকে। তারা আঘাত হানে মাতৃভাষার ওপর।
ভাষা নিয়ে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র বাঙালি রুখে দিয়েছিল বুকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই উন্মেষ ঘটে স্বাধিকার আন্দোলনের। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনের একপর্যায়ে ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ছয় দফা। সারা বাংলা ফুঁসে ওঠে অসহযোগ আন্দোলনে। জাতিকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের জন্য ঐক্যবদ্ধ ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলেন। ১৯৭১ সালের সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি শত্রুর মোকাবিলায় যার কাছে যা আছে তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেন। পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে আকস্মিকভাবে ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালাতে শুরু করলে বীর বাঙালি তাদের প্রতিরোধের সংগ্রামে আত্মনিবেদন করে। দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রাম শেষে এই দিনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় চিরকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। সেই রমনার রেসকোর্স ময়দানেই আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনী।
এবার ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর সেই কালজয়ী ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেওয়ায় এবারের বিজয় দিবসের উৎসব ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে।
সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে আজ সকাল থেকেই মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে অগণিত মানুষ পুষ্পস্তবক নিবেদন করে শ্রদ্ধা জানাবেন। রাজধানীর পাশাপাশি সারা দেশেই সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেবে বিজয় উৎসবে। আজ সরকারি ছুটির দিন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোর প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপ জাতীয় পতাকায় সজ্জিত করা হবে। রাতে গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় করা হবে আলোকসজ্জা। হাসপাতাল, কারাগার, এতিমখানাগুলোতে উন্নত খাবার পরিবেশন করা হবে।
বাণী: মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তাঁরা স্বাধীনতার জন্য আত্মদানকারী শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁদের বিদেহী আত্মার চিরকল্যাণ কামনা করেছেন এবং দেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
কর্মসূচি: প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে দিবসটির সূচনা হবে। সকাল ১০টায় তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দরের জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে সম্মিলিত বাহিনীর কুচকাওয়াজ ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমভিত্তিক প্রদর্শনী থাকবে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ প্রধান অতিথি হিসেবে কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
এ ছাড়া মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন তাদের নিজ নিজ কর্মসূচি নিয়েছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।