আনিসুল হকের মৃত্যুতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র পদ শূন্য ঘোষণার পর শোক কাটিয়ে না উঠতেই এ পদে উপনির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। কোন দলের কে প্রার্থী হতে পারেন তা নিয়েও চলছে জল্পনা-কল্পনা। তবে নির্বাচন হওয়া নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ডিএনসিসির সাথে যুক্ত হওয়া নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে এখনো কাউন্সিলর নির্বাচন হয়নি। মেয়রের নির্বাচন করতে গেলে নতুন ওয়ার্ডগুলোর ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন কি না এবং সেখানে কাউন্সিলর পদে ভোট হবে কি না, সে প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। সব জটিলতা এড়িয়ে কিভাবে নির্বাচন করা যায় তা ভাবছে নির্বাচন কমিশন।
গত ৩০ নভেম্বর লন্ডনে চিকিৎসারত ডিএনসিসি মেয়র আনিসুল হক ইন্তেকাল করেন। এরপর ৪ ডিসেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে ডিএনসিসির মেয়র পদ ১ ডিসেম্বর থেকে শূন্য ঘোষণা করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ফলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। ইসির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ৯০ দিনের মধ্যে মেয়র পদে উপনির্বাচন শেষ করতে হবে। কমিশন সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে অন্তত ৪৫ দিন হাতে রেখে তফসিল ঘোষণা করতে পারে।
জানা যায়, এবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হবে। ফলে দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে। এরই মধ্যে নির্বাচনে প্রার্থী নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন নিয়ম অনুযায়ীই হবে। মেয়র পদ শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন আইন আছে। কমিশন সে আইন অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন করবে। এর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
ডিএনসিসি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা চমকের কথা ভাবছি না। আমরা উইনিবল (জয় হওয়ার যোগ্য) প্রার্থীর কথা ভাবছি। এর মধ্যে রাজনৈতিক নেতা ও আওয়ামী মনোভাব সম্পন্ন ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের লোক কিন্তু নেতা নয় এমন কয়েকজনকে নিয়েও আমরা চিন্তা করছি। চূড়ান্ত না হলে কিছু বলা যাবে না।
বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি এ নির্বাচনে যাবে। তবে এখনো তারা প্রার্থী নিয়ে কোনো আলোচনা শুরু করেনি। গতবারের প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পাশাপাশি আরো কয়েকটি নাম আলোচনায় আছে। বিএনপি মনে করে, ভোট সুষ্ঠু হলে তারা জিতবে। কারণ গতবার বয়কট করার পরও তাদের প্রার্থী তাবিথ আউয়াল প্রায় তিন লাখ ভোট পেয়েছিলেন। আর ভোটে জোরজবরদস্তি হলে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তাদের এ দাবি আরো শক্ত ভিত্তি পাবে। নিরপে সরকারের দাবি আরো গ্রহণযোগ্যতা পাবে এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে এটি নিয়ে আলোচনা জোরদার হবে।
আনিসুল হকের মৃত্যুতে আসন্ন উপনির্বাচনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দৌড়ে আছেন সাবের হোসেন চৌধুরী, এ কে এম রহমতউল্লাহ ও বর্তমান প্যানেল মেয়র ওসমান গণি। তবে আওয়ামী লীগের সমর্থক কিন্তু সক্রিয় রাজনীতি করেন না এমন কাউকে এবারো মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়া হতে পারে। আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক বা তার ছেলে নাভিদুল হক মনোনয়ন পেতে পারেন। ব্যবসায়ী এ কে আজাদকেও মনোনয়ন দেয়া হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে।
২০১৫ সালের নির্বাচনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে উত্তরে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন আবদুল আউয়াল মিন্টু। সাথে তার ছেলেও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। মিন্টুর মনোনয়ন বাতিল হয়ে গেলে তার ছেলে তাবিথ আউয়াল বিএনপির প্রার্থী হন। নির্বাচনের দিন প্রথম প্রহরেই কারচুপির প্রতিবাদে সরে দাঁড়ান তাবিথ। তারপরও প্রায় তিন লাখ ভোট পেয়েছিলেন তিনি। এবারো তাবিথ আউয়ালই বিএনপির প্রার্থী হতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর বিএনপির উত্তরের সভাপতি এম এ কাইয়ুমের নাম রয়েছে আলোচনায়। প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট আইনজ্ঞ খন্দকার মাহবুব হোসেনের নামও শোনা যাচ্ছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন কিন ইমেজের অধিকারী এবং আইনাঙ্গনে তার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। উত্তর সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা হওয়ায় ওই এলাকাতে তার যথেষ্ট পরিচিতি ও সুনামও রয়েছে। তবে জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ও বিএনপির ক্রীড়া সম্পাদক আমিনুল হককে প্রার্থী করেও চমক দিতে পারে বিএনপি। ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হলে দলের বাইরে থেকে মাহমুদুর রহমান মান্নাকেও সমর্থন দিতে পারে বিএনপি।
বিগত নির্বাচনে বিকল্প ধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহি বি চৌধুরী, গণসংহতির জোনায়েদ সাকী, ইসলামী আন্দোলনের শেখ ফজলে বারী মাসউদ মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন। তারা এবারো প্রার্থী হতে পারেন।
তবে ডিএনসিসির সাথে নতুন যুক্ত হওয়া ১৮টি ওয়ার্ড নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। নতুন ওয়ার্ডগুলোর ভোটাররা মেয়র পদের উপনির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ এসব ওয়ার্ড গত নির্বাচনের সময় সিটি করপোরেশনের অংশ ছিল না। এসব ওয়ার্ডে এখন পর্যন্ত ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচনও হয়নি।
ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান আইনে নতুন এসব ওয়ার্ডে নির্বাচন করা কঠিন। কারণ নতুন ওয়ার্ড যুক্ত হলে সেখানে কিভাবে নির্বাচন হবে, সে বিষয়ে আইনে সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই। তবে জটিলতা এড়িয়ে কিভাবে নির্বাচন করা যায় তা নিয়ে ভাবছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, ঢাকা উত্তর সিটির বর্ধিত অংশ সংক্রান্ত সমস্যা নিরসনের জন্য ইসি ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আলোচনা করবে। এ জন্য আইন-বিধিতে সংশোধনের প্রয়োজন হলে, তা সমাধান করে নির্বাচনের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সরকারের মেয়াদপূর্তির শেষ বছরে এসে এ নির্বাচন রাজনীতির ময়দান উত্তপ্ত করতে বলে পারে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।