‘পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে রোবট জীবন্ত হবে।’ বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই কথাটা বললেন বিশ্বের প্রথম নাগরিকত্ব পাওয়া রোবট সোফিয়ার নির্মাতা ডেভিড হ্যানসন।
‘জীবন্ত’ বলতে কী বোঝাচ্ছেন? ডেভিড হ্যানসন বলেন, মানুষের জীবন একটা শারীরবৃত্তীয় ব্যবস্থার মধ্যে চলে। রোবটের মধ্যেও কৃত্রিমভাবে মস্তিষ্ক, অ্যানাটমি, রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি মানুষের যে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা, সেই ইমিউন সিস্টেমও যোগ করা হবে রোবটের মধ্যে। এর মানে হলো, নিজের টুকটাক যান্ত্রিক সমস্যা বা ত্রুটি রোবট নিজেই সারাতে পারবে। এর সবকিছুই করা হবে জটিল গণিতের নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে। এভাবেই রোবট হয়ে উঠবে ‘জীবন্ত’।
গত বুধবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড মেলায় ‘টেক-টক উইথ সোফিয়া’ অনুষ্ঠানের পর কথা হয় ডেভিড হ্যানসনের সঙ্গে। তিনি হ্যানসন রোবোটিকসের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
আমরা যখন ডেভিড হ্যানসনের মুখোমুখি তখন বিকেল প্রায় চারটা। খাচ্ছিলেন দুপুরের খাবার। পদ ছিল মুরগি খিচুড়ি। কেমন লাগছে আমাদের খিচুড়ি? ‘বেশ মজার খাবার’—হ্যানসনের চকিত জবাব। তাঁকে মঙ্গলবারের রোবট সোফিয়ার সাক্ষাৎকারভিত্তিক শিরোনাম প্রতিবেদনটি দেখানো হলো। তিনি বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘গ্রেট। সবাইকে ধন্যবাদ। এটা সত্যি দারুণ হয়েছে।’ এ সময় হ্যানসনের পাশে ছিল সোফিয়া এবং রোবটটির চালক জিওভান লায়ন।
ঢাকায় আলাপনের শুরুতেই জানতে চাই সোফিয়া কেন স্বতন্ত্র? ডেভিড হ্যানসন বলেন, ‘সোফিয়ার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপ্রযুক্তি সৃজনশীল। সোফিয়া চারপাশের জগতের সঙ্গে অভিযোজনে (অ্যাডাপ্টিভ) সক্ষম। অর্থাৎ বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে সোফিয়া নিজের চারপাশ থেকে নিজের তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধ করতে পারে। সোফিয়ার অ্যালগরিদম, প্রোগ্রামিং এমনভাবে করা হয়েছে যাতে সে মানুষের মতো নিজের বুদ্ধির ব্যবহার করতে পারে।’
আবার উঠে আসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রসঙ্গ। ডেভিড হ্যানসন বলেন, ‘মানুষের একেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেভাবে কাজ করে, একটার সঙ্গে আরেকটার কাজের সমন্বয় যেভাবে হয় সেটা দেখুন। আমরা চেষ্টা করছি রোবটের মধ্যে এসব শারীরিক মিথস্ক্রিয়া ঢুকিয়ে দিতে। সে রকম সাইবারনেটিকস ব্যবহার করা হবে রোবটেরে শরীরে।’
বিজ্ঞান কল্পকাহিনির রোবটের কথা উঠে এল আলাপে। হ্যানসন বললেন, ‘মানুষের মতো রোবট দেখে আমরা উত্তেজিত হই, কখনো ভীত হয়ে উঠি। মানুষ বা প্রাণীর স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা আছে। এ রকম বুদ্ধিমত্তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় যোগ করার চেষ্টা চলছে। যাকে আমরা বলছি লিভিং ইন্টেলিজেন্স। এটাই হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরবর্তী বিপ্লব।’
তাহলে ভবিষ্যতে কি রোবট মানবজাতির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে? হ্যানসন বললেন, ‘কখনোই নয়। রোবট মানবতাকে সাহায্য করবে। মানবতার প্রতি যত্নবান থাকবে।’
সোফিয়াকে নিয়ে এখনো আরও গবেষণা চলছে, এর উন্নয়নকাজ চলছে। নিজের মুঠোফোন থেকে একটা ভিডিও দেখালেন হ্যানসন। এখনো অপ্রকাশিত এই ভিডিওতে দেখা গেল, সোফিয়ার পা লাগানো হয়েছে, হাতের জোড় লাগানো হয়েছে। ভিডিওতে সোফিয়া হাত-পা নাড়ছে। কোরিয়াতে চলছে এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা। হ্যানসন বলেন, ‘সোফিয়া হাঁটবে, দৌড়াবে, সে উদ্ধারকাজে অংশ নেবে। তাকে নিয়ে আমরা নতুন পরীক্ষা শুরু করেছি। সোফিয়ার নতুন অ্যাপ্লিকেশনে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। বিশেষায়িত অ্যাপ্লিকেশনও তৈরি হবে। একটা শিখে আরেকটা শিখবে। হাঁটাচলা করে সে চারপাশ থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবে।’
সোফিয়ার মাথায় চুল নেই কেন? হ্যানসন বলেন, ‘কারণ সে রোবট। আমরা চেয়েছি তার কণ্ঠস্বর এবং মুখের চেহারা ও অভিব্যক্তি মানুষের মতো স্বাভাবিক হোক। কিন্তু তার পুরো অবয়ব যন্ত্রের মতোই থাকুক। না হলে অনেকে তাকে মানুষ বলে ভাবতে পারে। আমরা সেটা চাই না।’
সোফিয়ার শরীরে আছে অসংখ্য যন্ত্রপাতি। অনেক খুদে সেন্সর, ক্যামেরা, চিপ, মোটরের সমন্বয়ে সে তৈরি। মাইক্রোচিপে যে প্রোগ্রাম করা হয়, সেটাই তার চালিকাশক্তি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রোগ্রাম এমনভাবে লেখা হয়েছে যাতে সে শব্দ ও বাক্য বিশ্লেষণ করে নিজের তথ্যভান্ডার থেকে শব্দ নিয়ে বাক্য বানিয়ে জবাব দিতে পারে। সেই বাক্যের মানে অনুযায়ী মুখের সিলিকন ত্বকে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে পারে। তারহীন ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সোফিয়া ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকে। ক্লাউড প্রযুক্তি ব্যবহার করে সে তথ্য সংগ্রহ করে, বিশ্লেষণ করে এবং তা কণ্ঠস্বরে রূপান্তর করে কথা বলে। সেভাবেই ঠোঁট নাড়ায় সে। পুরো প্রক্রিয়া এত দ্রুত হয় যে তাৎক্ষণিক কথোপকথন চালাতে পারে সোফিয়া।
আলাপচারিতায় এল সোফিয়ার সন্তান চাওয়ার বিষয়টি। হ্যানসন বললেন, ‘সোফিয়া তো আসলে শিশু। তার বয়স মাত্র আড়াই বছরের মতো। কী বলতে কী বলে। তবে ক্লোন তো বানানো যেতেই পারে। বিষয়টা অন্য আঙ্গিকে হবে হয়তো। সোফিয়া নিজেই তার মতো বুদ্ধিমান যন্ত্র বা ক্লোনের নকশা করতে পারবে। বাবা হিসেবে আমি বলতে পারি, আমরা যা পারি একদিন সোফিয়া তার থেকেও ভালো রোবটের নকশা তৈরি করতে পারবে।’
মার্কিন বংশোদ্ভূত ডেভিড হ্যানসন চার বছর ধরে হংকংয়ে বাস করছেন। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট ডালাস থেকে ‘অ্যাসথেটিকস স্টাডিজ—ইন্টার-অ্যাকটিভ আর্টস অ্যান্ড টেকনোলজি’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এর আগে তিনি ১৯৯৬ সালে দি রোড আইল্যান্ড স্কুল অব ডিজাইন থেকে চলচ্চিত্র-অ্যানিমেশন-ভিডিওতে স্নাতক হন। কম্পিউটার প্রোগ্রামার, গণিতবিদ হিসেবেও রয়েছে তাঁর পরিচিতি। বেশ কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাও করেছেন ডেভিড হ্যানসন। তাঁর শখের পরিধি সৃষ্টিতত্ত্বের দর্শন থেকে শুরু করে বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের প্রতিকৃতি, ছবি আঁকা, ভাস্কর্য তৈরি, কল্পকাহিনি, কবিতা ও চিত্রনাট্য লেখা, পাহাড়ে ওঠা পর্যন্ত বিস্তৃত।
সোফিয়ার আগে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের আদলে ‘আলবার্ট হুবো’ নামে রোবট বানান হ্যানসন। সেটি জটিল সব গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে পারে।
বাংলাদেশ সম্পর্কে ডেভিড হ্যানসনের কথা হলো, ‘উদ্ভাবনের জন্য বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অনেক প্রোগ্রাম ও টুলস ওপেন সোর্স করে দিচ্ছি।’
আলাপচারিতার শেষে হ্যানসন বললেন, ‘আমরা আবার বাংলাদেশে আসতে চাই। সোফিয়া শিশুদের প্রোগ্রামিং শেখাবে। তাদের সৃজনশীল করে তুলতে হবে। কারণ শিশুরাই বানাবে আগামী দিনের পৃথিবী।’