বাবরি মসজিদ ভাঙার ২৫ বছর

Slider ফুলজান বিবির বাংলা

135012Babri

 

 

 

 

২৫ বছর কেটে গেছে।

কিন্তু এখনও ৬ ডিসেম্বর তারিখ আসলেই মনে হয়, আমি যেন অযোধ্যার মানস ভবন ধর্মশালার ছাদে দাঁড়িয়ে আছি আর বাবরি মসজিদ ভেঙে পড়ার গোটা দৃশ্যটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।

সে মানস ভবন ধর্মশালায় তার প্রায় বছর দশেক আগে, ১৯৮২ সালে আমি প্রথম গিয়েছিলাম। আমি সেখানে কয়েকদিন থেকেছিলাম। এক সাংবাদিক বন্ধু পাশের বাবরি মসজিদটা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন।

বিতর্কিত রাম-জন্মভূমি-বাবরি মসজিদের বাইরে, রাম চবুতরায় দিনরাত কীর্তন চলত আর চরণ পাদুকা, সীতা রসোইয়ের মতো কিছু কাল্পনিক স্থানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পরিক্রমার শেষে মাথা নত করত।

দীর্ঘদিন ধরেই রামানন্দী সম্প্রদায়ের নির্মোহী আখড়া রাম চবুতরা কবজা করে রেখেছিল। প্রায় ১২৫ বছর ধরে সেখানে মন্দির তৈরির জন্য আইনি লড়াই চালাচ্ছিল নির্মোহী আখড়া।

মসজিদের ভেতরে ভগবান রামের শিশুবয়সের একটা মূর্তি ছিল, যেটা ১৯৪৯ সালের ২২ আর ২৩ ডিসেম্বরের রাতে আবির্ভূত হয়, অথবা তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তায় সেখানে রেখে দেওয়া হয়।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু মসজিদের ভেতর থেকে মূর্তি সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সেই নির্দেশ পালন করতে অস্বীকার করেন।

তখনই আদালত মসজিদের দখল নিয়ে রিসিভার বসিয়ে দেয়। বাইরে পুলিশের পাহারা বসে আর আদালত নিযুক্ত একজন পূজারি ওই মূর্তিগুলোর পুজো-অর্চনা করতে থাকেন।

সংঘ পরিবার বহু দিন ধরেই এমন একটা ইস্যু খুঁজছিল যেটা দিয়ে তারা বহুধা বিভক্ত হিন্দু সম্প্রদায়কে একজোট করতে পারে।

মনে করা হয়, সেই উদ্দেশ্যেই ১৯৮৪ সালে রাম-জন্মভূমি মুক্তি আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের মধ্যেই ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, বিতর্কিত এলাকার তালা খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। কেন্দ্রে তখন রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন সরকার।

আদালতের ওই নির্দেশের প্রতিবাদেই গড়ে ওঠে বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি। আইনি লড়াই ততদিনে জেলা আদালত থেকে পৌঁছিয়েছে লক্ষ্ণৌ হাইকোর্টে।

পুরো বিষয়টি মীমাংসা করতে ১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে রাজীব গান্ধী বিতর্কিত এলাকা থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে, মানস ভবন ধর্মশালার ঠিক নিচে নতুন রাম মন্দিরের শিলান্যাস করিয়ে দেন।

রাজীব গান্ধী নির্বাচনে হেরে গেলেন। ভি পি সিং এবং চন্দ্রশেখরের সরকারও আপোষ মীমাংসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। অন্যদিকে ভারতীয় জনতা পার্টির বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি গুজরাটের সোমনাথ থেকে রথযাত্রা বের করে রাজনৈতিক ঝড় তুলে দিলেন।

১৯৯১ সালে দিল্লিতে ক্ষমতায় ফিরে এলো কংগ্রেস। প্রধানমন্ত্রী হলেন পি ভি নরসিমহা রাও। কিন্তু অন্যদিকে, রামমন্দির আন্দোলনের ওপরে ভরসা করে উত্তরপ্রদেশে সেই প্রথমবার বিজেপি সরকার গঠন করল। মুখ্যমন্ত্রী হলেন কল্যাণ সিং।

মি. সিংয়ের সরকার সুপ্রিম কোর্টে হলফ নামা পেশ করে মসজিদের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তার ভিত্তিতেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে নিয়ম রক্ষা করার মতো কর-সেবা করার অনুমতি দিয়েছিল সর্বোচ্চ আদালত।
কিন্তু তার আগেই তো বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপির নেতারা সারা দেশে ঘুরে কর সেবকদের উদ্দেশে বলেছেন যাতে মসজিদ সম্পূর্ণভাবে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়। রীতিমতো শপথ বাক্য পাঠ করানো হয়েছিল। আর সেসব কর সেবকদের ভরসা দেওয়ার জন্য কল্যাণ সিং ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে তাঁর পুলিশ কর সেবকদের ওপর কখনোই গুলি চালাবে না।

এর আগে ১৯৯০ সালে মুলায়ম সিং যাদবের সরকার কিন্তু কর সেবকদের ওপরে গুলি চালিয়েই মসজিদ ভেঙে ফেলা আটকিয়ে দিতে পেরেছিল।
কল্যাণ সিং বিতর্কিত এলাকার সংলগ্ন ৪২ একর জমি প্রস্তাবিত রামকথা পার্ক তৈরির জন্য বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে দিয়ে দেন।

এ ছাড়াও পর্যটন উন্নয়নের নাম করে বেশ কিছু মন্দির আর ধর্মশালার জমি অধিগ্রহণ করে জমি সমান করে দিয়েছিল কল্যাণ সিংয়ের সরকার।

ফৈজাবাদ থেকে সরাসরি অযোধ্যার বিতর্কিত এলাকা অবধি চওড়া সড়ক তৈরি করা হয়েছিল। সারা দেশ থেকে আসা কর সেবকদের থাকার জন্য বিতর্কিত এলাকার গায়ে লাগা জায়গায় লাইন দিয়ে তাঁবু খাটানো হয়েছিল।

তাঁবু খাটানোর জন্য কোদাল, মোটা রশি প্রচুর সংখ্যায় সেখানে জড়ো করা হয়েছিল। সেগুলো পরে মসজিদের গম্বুজগুলো ভেঙে ফেলার কাজে লাগানো হয়েছিল।

মোটের ওপরে বিতর্কিত পরিসরের চারদিকটা কর সেবকদেরই নিয়ন্ত্রণে ছিল।
এরা ৪-৫ দিন আগে থেকেই আশপাশের কিছু মাজারের ওপরে হামলা চালিয়ে আর মুসলমানদের কয়েকটা ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি গরম করে তুলেছিল আর নিজেদের আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমার পরিচয়ও দিতে শুরু করেছিল।
এসব সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত পরিদর্শক- জেলা জজ মি. তেজ শঙ্কর বারবার বলছিলেন যে শান্তিপূর্ণভাবে নিয়মরক্ষার কর-সেবা করানোর সব ব্যবস্থা করা হয়েছে।

একদিন আগে, ৫ ডিসেম্বর দুপুরবেলা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মার্গ দর্শক মন্ডল আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত নিল যে শুধুমাত্র নিয়মরক্ষার খাতিরেই কর-সেবা করা হবে বিতর্কিত এলাকায়।

তারা ঠিক করল যে কর সেবকরা সরযূ নদী থেকে জল আর মুঠি ভর মাটি নিয়ে আসবেন আর মসজিদের কাছেই মন্দিরের শিলান্যাস হয়েছে যেখানে, সেখানে ওই মাটি আর জল অর্পণ করে চলে যাবেন।

এই সিদ্ধান্তের কথা ছড়িয়ে পড়তেই কর-সেবকদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব করসেবকপুরম-এ [অযোধ্যায় কর-সেবকদের থাকা-খাওয়ার জন্য সাময়িক ব্যবস্থা ছিল যে চত্বরে] পৌঁছনোর সঙে সঙেই উত্তেজিত কর-সেবকরা তাকে ঘিরে ধরে অকথা-কুকথা বলছিল।
তারা বলছিল যে নেতারা যাই বলে থাকুন না কেন তারা আসল কর-সেবা করে তবেই ফিরবেন, অর্থাৎ মসজিদ ধ্বংস করবেনই তারা। সন্ধ্যে থেকেই কর-সেবকরা কয়েকজন টিভি সাংবাদিক আর ফটোগ্রাফারের সঙে দুর্বব্যহার করছিল, মারধর করছিল।

ওদিকে ভারতীয় জনতা পার্টির বর্ষীয়ান নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী লক্ষ্ণৌতে এক জনসভায় ভাষণ দিয়ে কর-সেবকদের আরও উৎসাহিত করে তোলেন।
মি. বাজপেয়ী সন্ধ্যের ট্রেনে দিল্লি চলে গিয়েছিলেন। আদভানি এবং মুরলী মনোহর যোশী- এই দুই নেতা মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংয়ের সঙে পরামর্শ করে রাতেই অযোধ্যা পৌঁছে যান।

সেটা ছিল ৫ ডিসেম্বরের রাত। পরের দিন ভোর থেকেই গোটা অযোধ্যা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে কেঁপে উঠছিল, অন্যদিকে পাশের শহর ফৈজাবাদের সেনা ছাউনিতে কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও তৈরি হচ্ছিলেন কারণ যে কোনও মুহূর্তে তাঁদের ডাক পড়তে পারে অযোধ্যার দখল নেওয়ার জন্য।
সেনা আর বিমানবাহিনীও নজরদারি চালাচ্ছিল।

রাজ্য সরকার তখনও তার আগের অবস্থানেই অনড় ছিল- আধা সামরিক বাহিনী বা সেনাবাহিনী কিছুই তারা নামাতে রাজী হয় নি। তাদের স্পষ্ট কথা- কর-সেবকদের ওপরে কোনও রকম বল প্রয়োগ চলবে না।

৬ তারিখ সকাল থেকেই আমরা সাংবাদিকরা মানস ভবন ধর্মশালার ছাদে প্রেস গ্যালারিতে জায়গা দখল করেছিলাম। মসজিদের ঠিক মুখোমুখি ছিল আমাদের জায়গাটা।

আমাদের ডানদিকে, ‘জন্মস্থান মন্দির’-এর ওপরে কমিশনার, ডিআইজি সহ প্রশাসন ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বসেছিলেন। আর বাঁদিকে রামকথা কুঞ্জ-তে একটা সভাস্থল তৈরি হয়েছিল যেখানে অশোক সিংঘল, আদভানি, মুরলী মনোহর যোশী, উমা ভারতীদের মতো শীর্ষ নেতারা জড়ো হয়েছিলেন।

মসজিদ আর আমাদের প্রেস গ্যালারি মানস ভবনের মাঝামাঝি যেখানে শিলান্যাস স্থল তৈরি হয়েছিল, সেখানেই ব্যবস্থা হয়েছিল যজ্ঞের। মহন্ত রামচন্দ্র পরমহংস সহ বহু সাধু সন্ন্যাসী সেখানে জড়ো হয়েছিলেন।

ঠিক এই জায়গাটাতেই বেলা ১১টা থেকে নিয়মরক্ষার কর-সেবা শুরু হওয়ার কথা ছিল।

চারদিকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা দেখভাল করছিল মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা আর এস এস সদস্যরা। তাদের পিছনে মোটা দড়ি লাগিয়ে দাঁড়িয়েছিল পুলিশ বাহিনী- যাতে শুধুমাত্র বিশিষ্ট ব্যক্তিরাই যজ্ঞস্থলে পৌঁছতে পারেন।

ঘড়ির কাঁটা যখন সাড়ে ১০টা ছুঁয়েছে, তখন ড. যোশী [মুরলী মনোহর যোশী] এবং মি. আদভানি [লালকৃষ্ণ আদভানি] যজ্ঞস্থলের দিকে এগিয়েছিলেন। তাঁদের পেছন পেছন বহু কর-সেবকও ঢুকে পড়ছিল- সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম।
পুলিশ চেষ্টা করেছিল তাদের আটকাতে, কিন্তু পারেনি।

তখনই ওই সাধারণ কর-সেবকদের ওপরে লাঠি চালাতে শুরু করে মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বাধা আরএসএস স্বেচ্ছাসেবকরা। খুব দ্রুত এর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় গোটা চত্ত্বরে।

মুহূর্তের মধ্যেই শতশত কর-সেবক মসজিদের দিকে দৌড়তে শুরু করে। মসজিদের নিরাপত্তার জন্য চারদিকে লোহার বেড়া লাগানো ছিল। পিছনের দিক থেকে একটা দল গাছের ওপর দিয়ে দড়ি ছুঁড়ে দিয়েছিল। সেই দড়ি বেয়েই কর-সেবকরা মসজিদে ঢোকার চেষ্টা করছিল। ভিআইপি এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল যে পুলিশ কর্মীরা, তারা কর-সেবকদের আটকাতে চেষ্টা করেছিল কিছুক্ষণ। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই একজন একজন করে কর-সেবক দড়ি বেয়ে মসজিদের গম্বুজে উঠে পড়ছিল। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম স্পষ্টই।

মসজিদের গম্বুজের ওপরে কয়েকজন কর-সেবক পৌঁছিয়ে গেছেন, এটা দেখেই চারদিকে প্রচণ্ড আওয়াজ উঠতে লাগল, ‘এক ধাক্কা অউর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো’ [আরো একটা ধাক্কা দাও, বাবরি মসজিদ ভেঙে দাও]।

মাইকে অশোক সিংঘল [বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রধান] কর-সেবকদের বার বার অনুরোধ করছিলেন গম্বুজ থেকে নিচে নেমে আসার জন্য। কিন্তু তার সেই কথায় কেউ কানই দিচ্ছিল না।

যার হাতে যা ছিল- কোদাল, শাবল, গাঁইতি- তাই দিয়েই গম্বুজের ওপরে আঘাত করা হচ্ছিল। কয়েকজনকে তো দেখছিলাম চুন-সুড়কি দিয়ে তৈরি মসজিদের গায়ে হাত দিয়েই গর্ত করছে!

এরই মধ্যে মসজিদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সশস্ত্র পুলিশ কর্মীরা কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে বাইরে চলে এলো। পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন- কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তাঁরা।
কর-সেবকদের একটা অংশ আবার আশেপাশের সব টেলিফোনের তার কেটে দিচ্ছিল। অন্য একটা দল মানস ভবনের ছাদে আমাদের প্রেস গ্যালারীতে উঠে এলো। চিত্র সাংবাদিকদের তারা স্পষ্টই ছবি তুলতে বারণ করে দিল। আমি আমার ক্যামেরাটা এক নারী সাংবাদিকের ব্যাগে লুকিয়ে রাখলাম।  তবে বেশ কয়েকজন চিত্র সাংবাদিকের ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে তাদের মারধরও করা হয়েছিল নিচে।

মি. আদভানির আশঙ্কা ছিল ফৈজাবাদ থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী বা এমন কি সেনাবাহিনীকেও তলব করা হতে পারে। তাই তিনি জনতাকে আহ্বান করলেন সবাই যাতে ফৈজাবাদ-অযোধ্যা প্রধান সড়কে অবরোধ তৈরি করে।

মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংয়ের কাছে যখন সব খবর পৌঁছল, তিনি তখনই পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু মি. আদভানি বাধ সাধেন। কল্যাণ সিংকে তিনি বুঝিয়েছিলেন যে মসজিদ ভেঙে পড়ার আগেই পদত্যাগ করলে সঙে সঙেই রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়ে যাবে, গোটা ব্যবস্থাই নিয়ন্ত্রণ করবে দিল্লির কংগ্রেস সরকার।

অবশেষে বিকেল ৫টা নাগাদ কল্যাণ সিং ইস্তফা জমা দিয়েছিলেন- ততক্ষণে বাবরি মসজিদের তিনটি গম্বুজই ভেঙে পড়েছে।

রাষ্ট্রপতি শাসন তো জারি হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের সঙে সঙেই। কিন্তু প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বুঝে উঠতে পারছিলেন না যে কী করা উচিত!

অন্যদিকে কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বা সেনাবাহিনী নামিয়ে দেওয়া হতে পারে, এই ভয়ে অযোধ্যা থেকে তখন কর-সেবকরা দ্রুত চলে যাচ্ছেন।

বহু কর-সেবক স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে বাবরি মসজিদের একটা ইটের টুকরো সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। মসজিদ ভেঙে ফেলার দায়ে লক্ষ লক্ষ অজ্ঞাত কর-সেবকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিল পুলিশ। তবে বিজেপি ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আট জন শীর্ষ নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের করেছিল পুলিশ। ওদিকে প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাও সারাদিন নিশ্চুপ ছিলেন।

সন্ধ্যাবেলা জাতির উদ্দেশে দেওয়া বিশেষ ভাষণে তিনি অবশ্য গোটা ঘটনার চূড়ান্ত নিন্দা করেই থেমে থাকেননি, মসজিদ পুনর্নির্মাণের কথাও বলেছিলেন।
অন্যদিকে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে বলপ্রয়োগ না করে যাতে অযোধ্যা থেকে কর-সেবকদের সরিয়ে দেওয়া যায়, তার জন্য দিল্লির নির্দেশে প্রচুর বিশেষ ট্রেন ও বাস চালানো হয়েছিল।

কর-সেবকদের একটা গোষ্ঠী ততক্ষণে মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ওপরই অস্থায়ী রামমন্দির তৈরি করছিল। মূর্তিও বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরের দিন, সাত ডিসেম্বর, আমরা সবাই সারাদিন অপেক্ষা করেছিলাম যে কখন পুলিশ প্রশাসন মসজিদের ধ্বংসস্তূপের দখল নেবে, তার জন্য।

ভোর ৪টা নাগাদ কিছু হতে পারে এ রকম খবর পেয়ে দৌড়লাম বিতর্কিত এলাকায়। দেখলাম হাতে গোণা যে কয়েকজন কর-সেবক সেখানে ছিলেন, তাদের সরিয়ে দিয়ে অস্থায়ী মন্দিরের দখল নিল প্রশাসন।

তবে পুলিশ আর কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যরা দেখলাম ওই অস্থায়ী মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত রামলালার মূর্তি দর্শন করে খুব শ্রদ্ধার সঙে মাথা নুইয়ে আশীর্বাদ নিচ্ছে। সেই সব ছবিও তুলেছিলাম আমি।

মসজিদ ধ্বংস হওয়া আর বিতর্কিত এলাকার আবারও দখল নেওয়া – দুটো খবরই আমি প্রথম পাঠাই বিবিসির কাছে।

সেটার জন্য যেমন গর্ব হয় এখনও, তেমনই সিকি শতাব্দী পরে যখন গোটা ঘটনাটা ফিরে দেখি, তখন কেবলই মনে হয় সেদিন আসলে আমার চোখের সামনে শুধুই একটা মসজিদ ভেঙে পড়ে নি।

ভারতের সংবিধানের তিনটি স্তম্ভ- আইনসভা, প্রশাসন আর বিচারব্যবস্থা- তিনটির মর্যাদাও সেদিন ভেঙে গিয়েছিল।

আইনের শাসনের বুনিয়াদী ধারণাটাই ভেঙে পড়েছিল ৬ ডিসেম্বর। আঘাত এসেছিল গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে পরিচিত গণমাধ্যমের ওপরেও।

আর যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং-সেবক সংঘ বা আর এস এস কঠোর নিয়ম, কড়া অনুশাসন পালনের জন্য পরিচিত, সেই ‘সংঘীয় অনুশাসন’ও চোখের সামনেই ভেঙে গিয়েছিল।

সব কিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার পরেও গত ২৫ বছরে বাবরি মসজিদ- রাম-জন্মভূমি নিয়ে বিতর্ক কিন্তু যেখানে ছিল, সেখানেই রয়ে গেছে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *