নেপালের একটা মহাপর্বত হিমালয় ও তার শীর্ষ শিখর এভারেস্ট আছে—তা দেখতে কত মানুষ যায়। আমাদের দেশে অমন পর্বতমালা নেই, এভারেস্ট দেখা (অবশ্য প্লেনের জানালা থেকে) তাই এক অভিজ্ঞতা। সেই নেপালে এক মহা নির্বাচনযজ্ঞ চলছে, তা দেখাও এক অভিজ্ঞতাই বটে। বিশেষত সেই দেশের মানুষের জন্য, যারা যুগান্তকারী নির্বাচন কী জিনিস তা প্রায় ভুলতেই বসেছে। ঘটনার মধ্যে আরও ঘটনা এই: নেপালের প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল নেপালি কংগ্রেস ও মাওবাদী সেন্টার পার্টি মিলে চালাচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার; অবশ্য আরও দুটি ছোট দলের সঙ্গে মিলে। আর সেই দেশের নির্বাচন কমিশন এমনই এক লোকের নেতৃত্বে, যিনি কিনা একই সঙ্গে সব রাজনৈতিক দল এবং ভোটারমণ্ডলী—সবারই আস্থাভাজন। আয়োধী প্রসাদ যাদব নামের এই ব্যক্তি যেন জীবনানন্দ দাশের কবিতার সুবিনয় মুস্তফীর মতো, যিনি বিড়াল ও বিড়ালের মুখে ধরা ইঁদুরকে একসঙ্গে হাসাতে পারেন। এটা একা তাঁর কৃতিত্ব নয়, নেপালের রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতাই তাঁর মতো ব্যক্তিকে দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দিয়েছে।
নেপালের জনগণ তো আরও সরেস ও বুঝদার। বাংলাদেশিদের চেয়ে অনেক গরিব ও কম শিক্ষিত মানুষের এক দেশ। অথচ দেশটায় সারা বছরে মহা সমারোহে নির্বাচন চলছে—বড় গন্ডগোল ছাড়াই। গত মে-জুলাই মাসে সেখানে ২০ বছর পর হতে পারল স্থানীয় সরকার নির্বাচন। আর ২৬ নভেম্বর ও ৭ ডিসেম্বর, দুই দফায় হচ্ছে জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচন। কিন্তু দলে দলে, ভোটারে ভোটারে মারাত্মক কোনো সহিংসতা নেই। স্থানীয় নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৭৫ শতাংশ, আর জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনের প্রথম দফায় (২৬ নভেম্বর) ভোট পড়েছে ৬৫ শতাংশ। স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দানের এই হার বুঝিয়ে দেয়, এই গণতন্ত্র তৃণমূলেই বেশি জীবন্ত এবং এই গণতন্ত্রের অন্যতম চালিকাশক্তি নেপালের মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি গ্রাম থেকেই রাজপ্রাসাদকেন্দ্রিক রাজতন্ত্র উচ্ছেদের সংগ্রামে গতিবেগ জুগিয়ে এসেছে।
কিন্তু সেই বিপ্লবীরা মনে হয় কিছুটা ক্লান্ত। বিপ্লবীরা স্বর্ণ জমায় না। কিন্তু ক্ষমতাসীন হয়ে মাওবাদীদের কিছু কিছু নেতাও অন্য দলগুলির মতোই দুর্নীতি ও শৌখিনতায় মজেছেন। তারই ফল পেয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে। জাতীয়তাবাদী কমিউনিস্ট পার্টি (ইউএমএল) সেই নির্বাচনে হয়েছে প্রথম, তৃতীয় হয়েছে মাওবাদী কমিউনিস্টরা। দ্বিতীয় হয়েছে সবচেয়ে পুরোনো দল নেপালি কংগ্রেস। নেপালের ভোটারদের যতজনের সঙ্গে কথা হয়েছে, মনে হয়েছে দুটি প্রশ্নে তাঁরা এককাট্টা। প্রথমত, তাঁরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে, দ্বিতীয়ত, নেপালের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিষয়ে তাঁরা আগের চেয়ে আপসহীন।
দুদিন পর, সাত ডিসেম্বরে বাদবাকি জেলাগুলোর নির্বাচনে এই দুই প্রশ্নেই তাঁরা ভোট দেবেন। দুর্নীতি ও আঞ্চলিক আধিপত্য বিরোধিতার এই মনোভাবের ওপর নাম, নেপালের দারিদ্র্যমুক্তির উন্নয়ন। দশকের পর দশক ধরে চলা অস্থিরতায় অবকাঠামো নির্মাণ, উৎপাদনের চাকা ঘোরানোর গতি থমকে আছে। ২০১৫ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপের ধুলা সরিয়ে নতুন দেশ তাঁরা গড়তে চান। সেটা পাননি বলেই রাজনীতিবিদদের প্রতি হতাশা বাড়ছে।
রাজনৈতিক হতাশা এক অদ্ভুত জিনিস। হতাশা সর্বব্যাপী হলে বিপ্লব হয়। কিন্তু যদি আশা থাকে, তাহলে মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে তার বাস্তবায়নে মেতে ওঠে। নতজানু হাওয়া বুঝে নির্বাচনী জোটই শুধু নয়, ঐক্যবদ্ধ পার্টি গড়তে চলেছে সাবেক ক্ষমতাসীন দুই কমিউনিস্ট পার্টি। তিন মাস আগের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের এক নম্বর ও তিন নম্বর শক্তির ঐক্যবদ্ধ ‘বাম জোটকে’ মোকাবিলা করতে হচ্ছে কংগ্রেস ও ছোট দুটি দলের ‘গণতান্ত্রিক জোট’। বাম ও গণতান্ত্রিক জোটের অলিখিত পরিচয় অবশ্য চীন বনাম ভারতপন্থী বলে দাগানো। স্বাভাবিকভাবেই স্থলাবদ্ধ নেপালের ঝোঁক প্রথম জোটের দিকেই। নেপালের এই নির্বাচন কেবল গণতান্ত্রিক রিপাবলিকের প্রথম সরকারই নির্বাচন করবে না, হিন্দুরাষ্ট্র থেকে সেক্যুলার এবং কেন্দ্রীভূত থেকে ফেডারেল ধরনের শাসনব্যবস্থাতেই থেমে থাকবে না, তা এশিয়ার এ অঞ্চলে পরাশক্তির ক্ষমতার ভারসাম্যেও বদল আনতে যাচ্ছে। এ কারণেই এর তাৎপর্য বৈশ্বিক হয়ে দাঁড়িয়েছে; ভারত ও চীন গভীর মনোযোগের সঙ্গে এই পালাবাদল লক্ষ করছে।
এই টানাপোড়েনই লক্ষ করা গেল প্রথম দফা নির্বাচনের ঠিক আগের দিনের স্থানীয় ইংরেজি পত্রিকা রিপাবলিকার প্রথম পৃষ্ঠার দ্বিতীয় শিরোনামে। সংবাদটি জানায়, নেপালি কংগ্রেস পরিচালিত সরকার চীনের সঙ্গে সম্পাদিত একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে। নেপালের উন্নতি ও আয়ের প্রধান ভরসা জলবিদ্যুৎ শক্তি। ১২০০ মেগাওয়াটের বুধি গান্ডাকি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের এই চুক্তিটি মাওবাদী প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল ওরফে প্রচন্ডের আমলে করা। বর্তমান ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকার নির্বাচনের পূর্বলগ্নে সেটি বাতিল করে কোনো একটা বার্তা দিতে চাইল। জবাবে বাম জোট বলেছে, ক্ষমতাসীন হলে তারা আবার এই প্রকল্প চালু করবে। স্ববিরোধিতার বিষয় এই, প্রচণ্ড যখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে চুক্তিটি করেন, তখন কংগ্রেস ছিল সেই সরকারের অংশ। আর এখন কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা যখন চুক্তিটি বাতিল করছেন, তখন মাওবাদীরা তাঁর নির্বাচনকালীন সরকারের অংশ। উল্লেখ্য, এই সরকারই কিন্তু সময়সীমার মধ্যে কাজ শুরু করতে ব্যর্থ ভারতীয় কোম্পানিকে বারবার সুযোগ দিয়ে চলেছে। অন্যদিকে বিরোধ সত্ত্বেও সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদাহরণও কিন্তু তারাই রচনা করেছে।
দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের আগে দ্বিতীয় দফা নীরবপর্ব ঘোষিত হয়েছে গতকাল থেকে। কিন্তু সশব্দে বোমা ফাটা থেমে নেই। গতকাল আহত হয়েছেন কংগ্রেস দলের এক প্রার্থীসহ নয়জন। কংগ্রেস বলেছে, নির্বাচন হবেই। নেপালের বড় তিনটি দল মিলেই নতুন সংবিধান রচনা করেছে, দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মিলে নির্বাচনকালীন সরকার চালাচ্ছে, দলীয় শিবিরগুলোর মধ্যেও দৃশ্যগোচর শত্রুতা যখন দেখা যায়নি, তখন এই বোমা কার হয়ে কথা বলছে, কারা নির্বাচন থামিয়ে দিতে চায়, তা এক রহস্য বটে।
তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য, নেপালের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকের বিশ্লেষণ, জনগণের প্রত্যাশা এবং শীর্ষ নেতাদের প্রকাশ্য বক্তব্য বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, অর্ধেক অঞ্চলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর; চূড়ান্ত নির্বাচনের ঠিক আগের বাস্তবতায় নির্বাচন ভন্ডুল করা যে কারও পক্ষেই খুব কঠিন।
গত ২৪ নভেম্বর বিকেলে রাজধানী কাঠমান্ডুতে পা দিয়ে পেয়েছিলাম শীত, ধূলি আর নীরবতা। নির্বাচনের দুদিন আগেই সেখানে চূড়ান্ত নীরব পর্ব ঘোষণা করা হয়। সব রকম প্রচারণা, ভোটার-সংযোগ, প্রতীক বহন নিষিদ্ধ। সাধারণ মানুষও স্পিকটি নট—জবান বন্ধ। কিন্তু তাদের আশা, এই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে দশ বছরে নয়টি সরকারের যাওয়া-আসার অস্থিরতার অবসান হবে। নেপাল পাঁচ বছর স্থায়ী সরকার পাবে, নবগঠিত প্রদেশগুলোর প্রতিনিধি সভা জোরেশোরে আঞ্চলিক উন্নয়নের কাজ শুরু করতে পারবে। জনগণের উচ্চাশার চেয়ে বড় শক্তি কিছু নেই। নেপালের মানুষ চাইতে শিখেছে, ধৈর্য ধরতে জেনেছে, দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে সম্প্রীতি ও উন্নয়নের পথে চলছে; গণতন্ত্রের জন্য এর চেয়ে স্বাস্থ্যকর ঘটনা আর কী হতে পারে।
ফিরে আসার সময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার ভাষায় বলতে ইচ্ছা হলো, ‘দেখিস, একদিন আমরাও!’
কাকে আর বলব, সংকল্পে অটল হিমালয়কেই বললাম।