২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠান অপরিহার্য ছিল বলে মন্তব্য করেন। একইসাথে তিনি মধ্যবর্তী নির্বাচনেরও ইঙ্গিত দেন। নির্বাচনের আগে ও পরে সকারবিরোধী জোটের টানা আন্দোলনের মধ্যে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও মধ্যবর্তী নির্বাচনের আভাস দিয়েছিলেন। সরকারের এমন অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছিলেন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরাও।
পরে সময়ের সাথে সাথে আওয়ামী লীগ সেই অবস্থান থেকে সরে গিয়ে এ সরকারকে সাংবিধানিকভাবে ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত বলে দাবি করেন। সরকারের নানা কৌশল এবং বিরোধীদের দমন-পীড়নের মুখে মধ্যবর্তী নির্বাচনের বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। তবে সরকারের মেয়াদের শেষ মুহূর্তে এসে আবারো আলোচনায় এসেছে মধ্যবর্তী নির্বাচনের বিষয়টি। সরকার চাইলে আগাম নির্বাচনে প্রস্তুত ইসিÑ বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এমন বক্তব্যের পর নতুন করে আলোচনায় স্থান পায় ইস্যুটি। মধ্যবর্তী নির্বাচনের জোর গুঞ্জন চলছে রাজনৈতিক মহলেও।
তাহলে দেশে কি আগামী ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন হতে যাচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘নির্বাচনের বিষয় প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার, তিনি তো বলেননি যে কবে নির্বাচন হবে। আমরা ধরে রাখছি সংবিধান অনুযায়ী আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু এখন যদি প্রধানমন্ত্রী মনে করেন তিনি আগাম নির্বাচন দেবেন, সেটা তার এখতিয়ার। এটা নিয়ে আমাদের সাথে কোনো কথা হয়নি। তবে নির্বাচনের জন্য আমরা সব সময়ই প্রস্তুত আছি, নির্বাচন যদি আগামী মাসেও হয় আওয়ামী লীগ প্রস্তুত।’
এ দিকে বিএনপিও আগাম নির্বাচনে প্রস্তুত রয়েছে জানিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘যেকোনো সময় নির্বাচন হলে অংশগ্রহণে বিএনপি প্রস্তুত রয়েছে। তবে তা অবশ্যই নিরপে ও সুষ্ঠু হতে হবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে দেশে যে অরাজকতাপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল সে অবস্থায় একতরফা নির্বাচনের পে ছিল না জাতিসঙ্ঘ, দাতাসংস্থা ও বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের কূটনীতিকরা। কিন্তু সরকার অনড় অবস্থানে থেকে একতরফা নির্বাচন করতে সম হলেও সে সময় বিদেশী কূটনীতিক, দাতাসংস্থার প্রতিনিধিদের এই মর্মে আশ্বস্ত করেছিল যে, এটি একটি নিয়মরার নির্বাচন। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচন করবে তারা। কিন্তু নির্বাচনের পর বিএনপি আন্দোলন থেকে সরে গেলে সরকারের ওপর কোনো দৃশ্যমান চাপ না থাকায় সে প্রতিশ্রুতি ভুলে যেতে চেষ্টা করে তারা। বর্তমানে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য সরকারের সামনে দৃশ্যমান কোনো চ্যালেঞ্জ বা চাপ না থাকলেও হঠাৎ করেই আলোচনায় উঠে এসেছে আগাম জাতীয় নির্বাচনের কথা। জাতীয় গণমাধ্যমগুলোতেও হঠাৎ করেই আগাম নির্বাচন নিয়ে আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর কিংবা ২০১৭ সালের প্রথমার্ধে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন করার ল্য নিয়ে ভেতরে ভেতরে বিভিন্ন প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল সরকার, যদিও এ বিষয়ে সরকারের কেউ মুখ খোলেনি। সেই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন জনসভায় নৌকার পক্ষে ভোটও চান। তবে নানা ইস্যুতে সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। অবশেষে ২০১৮ সালের প্রথমার্ধে একটি আগাম নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বন্যা ও রোহিঙ্গাসহ নানা ইস্যুতে নতুন সঙ্কট শুরু হওয়ায় বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত করা যায়নি।
সরকারের বিশ্বস্ত সূত্রগুলো জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২০ সালে তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী বছরব্যাপী মহা ধুমধামের সাথে পালন করতে চান। একইসাথে তিনি ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান শতাধিক বিদেশী রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের উপস্থিতিতে করতে চান। কিন্তু বর্তমান মেয়াদে তার পে এ দু’টি কাজ সমাধা করা সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমান সংসদের মেয়াদ রয়েছে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে যদি শেখ হাসিনা এ দু’টি অনুষ্ঠান রাষ্ট্রীয় মতায় থেকে উদযাপন করতে চান তবে তাকে ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করতে হবে। সে জন্য বিরোধী বিএনপি-জামায়াত জোটকে চাপে ও ভঙ্গুর অবস্থায় রেখেই একাধিকবার মধ্যবর্তী নির্বাচনের পরিকল্পনা নিতে হয়েছিল।
এতে এক দিকে যেমন সরকার ৫ জানুয়ারির ‘ভোটারবিহীন একতরফা’ নির্বাচনের দায় থেকে মুক্তি পাবে, তেমনি নতুন করে ক্ষমতায় এসে আরো ৫ বছর শাসনক্ষমতা ভোগ করতে পারবে। কিন্তু হিসাব নিকাশে না মেলায় মধ্যবর্তী নির্বাচনে যায়নি সরকার। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা উড়িয়ে দেন। তবে আগামী নির্বাচনপূর্ব সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিরোধী জোটের আন্দোলন এবং জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মামলা ও রায় ইস্যুতে অস্থিরতার আশঙ্কায় নতুন করে আবারো আগাম নির্বাচনের বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ বিএনপিকে অপ্রস্তুত রেখে আগাম নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয় নিশ্চিত করে অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করার পক্ষে।
অন্য দিকে নীতিনির্ধারকদের আরেকটি অংশ মেয়াদের শেষ সময়ে এসে আর আগাম নির্বাচন চায় না। তাদের মতে, আগাম নির্বাচন দেয়া হলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে আবারো নতুন করে সঙ্কটে পড়তে পারে সরকার। এ ছাড়া বিএনপিকেও অপ্রস্তুত হিসেবে মনে করছেন না তারা। তাদের দাবি, সম্প্রতি খালেদা জিয়ার কক্সবাজার সফর এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে তাদের প্রস্তুতি ও জনসমর্থনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিকবার বলেছেন, ‘বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হলেও তাদের জনসমর্থন অনেক বেশি। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আমাদের কাজ করতে হবে।’ এ ছাড়া বিএনপি আগামী নির্বাচনে কয়েকটি স্তরে সম্ভাব্য প্রার্থী ঠিক করে রেখেছে বলেও খবর বেরুচ্ছে। তারা নিয়মিত মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। সে জন্য মেয়াদের শেষ সময়ে এসে আগাম নির্বাচন দিয়ে নতুন করে কোনো বিপদ ডেকে আনার পক্ষে নন তারা।
সূত্রগুলো জানায়, নীতিনির্ধারকদের এমন দ্বিধাবিভক্ত মতের পর বিষয়টি এক রকম থেমে আছে। তবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারের জনপ্রিয়তা যাচাই শেষে আগাম নির্বাচনের বিষয়টি ‘সিরিয়াসলি’ ভাবাও হতে পারে।
দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সাথে আলাপ করে জানা গেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামও হতে পারে, নির্ধারিত সময় পার করেও হতে পারে। নির্বাচন নিয়ে দুই ধরনের প্রস্তুতিই নিয়ে রেখেছে মতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে জনপ্রিয়তায় ধস নামার আশঙ্কা দেখা দিলে এবং একইসাথে বিএনপিকে অসংগঠিত রাখতে পারলে আগাম নির্বাচনের দিকে ঝুঁকবে দলটি। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হলে বিএনপি সংগঠিত হয়ে যাবে এমন সম্ভাবনা থাকলেও আগাম নির্বাচনের পথে হাঁটবে মতাসীনেরা। তার আগে নির্বাচন কখন হলে সুফল পাওয়া যাবে তা নিশ্চিত হয়ে এই সিদ্ধান্ত নেবে আওয়ামী লীগ। তাই নির্বাচনের সুবিধাজনক সময় কখন সেটা নির্ণয় করতে কাজ করছে ক্ষমতাসীনেরা।
নীতিনির্ধারকরা জানান, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাদেরকে আগাম নির্বাচন হতে পারে এমন আভাস দিয়েছেন বেশ কয়েকবার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, নির্বাচন কখন হলে আওয়ামী লীগ সুবিধা পাবে তা নিশ্চিত হতে দফায় দফায় জরিপ চালানো হচ্ছে। এ ছাড়াও সরকারের জনপ্রিয়তা যাচাই, এমপিদের নিজ নিজ এলাকায় ইমেজ কী তা নিশ্চিত হওয়ার কাজ চলছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন হলে কী সুফল পাবে আওয়ামী লীগ, আবার নির্ধারিত মেয়াদ শেষ করে নির্বাচন হলে ঘরে কী সুফল আসবে এ মুহূর্তে তার পর্যালোচনা চলছে ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকদের ভেতরে।
অন্য দিকে কিছু নেতা বলছেন, এ মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচনের আওয়াজ মূলত বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল। কারণ, আন্দোলনমুখী রাজনীতিতে বিএনপি চলে যাক তা চায় না সরকার। বিএনপি আপাতত যাতে নির্বাচনের বাইরে কোনো চিন্তা-ভাবনা করতে না পারে সে জন্য আগাম নির্বাচনের আওয়াজ মাঠে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।