৭১’পরবর্তী সময়ে অনেক কিছু বদলে গেলেও বদলায়নি রুপতেরা বিবির ভাগ্য

Slider টপ নিউজ নারী ও শিশু সিলেট
GetImage1-1
হাফিজুল ইসলাম লস্কর ::
৭১’র সাহসী যুবতী মুক্তিযোদ্ধা রুপতেরা বিবি কালের পরিক্রমায় আজ ৮০ বছরের বৃদ্ধা। আজ বাংলাদেশের অনেক কিছু বদলে গেছে, যুদ্ধে ধবংস প্রায় দেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হয়ে। কিন্তু বদলায়নি কেবল রুপতেরা বিবির ভাগ্য, মুক্তিযোদ্ধের যুবতী রুপতেরা বিবি জীবনের শেষ সময়ে এসে উপনিত হয়েছেন, তবুও ভিক্ষা করেই জীবনের ঘানি টানতে হচ্ছে তাঁকে। তাও সব সময় খাবার জুটছেনা। মাঝে মাঝে উপবাস করতে হয়। থাকার মতো একটি ঘরও নেই। কোনমতে কুঁড়ে ঘরে দিন কাটছে তাঁর।
অথচ একাত্তরে যুবতী রুপতেরা বিবি মহান মুক্তিযুদ্ধে রেখেছেন অসামান্য অবদান। রাজাকার হানাদারদের অবস্থান আর গতিবিধির খবরা-খবর জানাতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। সেকারণে তাঁকে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। ঘরের মালামাল লুন্ঠন করেছে খান সেনা ও তাদের দোসররা। তাদের নির্যাতনে তিনি আহতও হয়েছিলেন।
রুপতেরা বিবির বাড়ি কানাইঘাটের দিঘীরপার পুর্ব ইউনিয়নের জয়ফৌদ গ্রামে। স্বামী মৃত তৈয়ব আলী।
তাঁর ৪ সন্তান। ৩ ছেলে আর ১ মেয়ে। মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। আর ছেলেরা দিন মজুর। চরম দরিদ্র সবাই। আর তাই ৮০ পেরিয়েও তাঁকে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে ছুটতে হয়। ঝুটলে খান, না ঝুটলে উপবাস।
অথচ মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে তাঁকে চিঠি (নং প্রত্রাক্/৬-৪-৭২/সিডি/২০৮১, তারিখ: ১১-১২) দিয়েছিলেন। দিয়েছিলেন ৫০০টাকা ভাতাও (চেক নং- সিএ ০১৭৮৩৩)। সেই চিঠিতে তিনি তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকারও করেছিলেন।
৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রুপতেরা বিবির বাড়ির পাশেই হানাদার-রাজাকার মিলে বাংকার খনন করেছিলো। আর রুপতেরা বিবি তাদের সব খবরা খবর পৌঁছে দিতেন মুক্তিবাহিনীর কাছে। তার সাহসী কৌশলের কাছে বার বার পরাজিত হয় পাকবাহিনী।
তাঁর দেওয়া তথ্য মতো হানাদারদের উপর হামলা চালায় মুক্তি বাহিনী। সেই হামলায় হানাদাররা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিহত হয় অনেকে। আহত হন অনেক মুক্তিযোদ্ধা।
পরে হানাদার-রাজাকাররা মিলে রুপতেরার বাড়িতেও বোমা ছুঁড়ে, গুলিবর্ষন করে। অন্য অনেকের মতো সেদিন তিনিও মারাত্মক আহত হন। সিলেট শহরের একটি হাসপাতালে তাকে কাটাতে হয় প্রায় ৪ মাস। মৃত্যুর সাথে লড়তে হয় পাঞ্জা। পরে বাড়িতে ফিরে আসেন। দুঃখ কষ্টেই কাটতে থাকে তার দিন।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা গঠন করার সময় রুপতেরা বিবির স্বামী মারা যান। এরপর তার যুদ্ধাহতের চিকিৎসার কাগজপত্র এবং বঙ্গবন্ধুর প্রেরিত পত্রখানাও হারিয়ে ফেলেন।
অত্যান্ত দুঃখজনকভাবে তালিকাভূক্ত হতে পারলেননা রুপতেরা বিবি। পেলেননা ভাতা। শুরু হলো তার ভিক্ষা বৃত্তির দিন।
বহু বছর পর তিনি যুদ্ধাহতের কাগজপত্রগুলো খুঁজে পান। বছরখানেক আগে তার ছেলেরা ঢাকায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে আবেদন করেন। কিন্তু ‘তদন্ত’ সংক্রান্ত জটিলতার আজও অবসান হয়নি। সেই সাথে অবসান হয়নি অসীম সাহসী মু্ক্তিযোদ্ধা রুপতেরা বিবির ভিক্ষাবৃত্তির জীবনও।
রুপতেরার পুরো বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে কানাইঘাটের নবনিযুক্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া সুলতানা বলেন, আমিতো কিছু জানিনা। আমার কাছে এলে, কাগজপত্র দেখে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
দিঘীরপার পুর্ব ইউপি চেয়ারম্যান আলী হোসেন কাজল জানান, রুপতেরা বিবি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, এটা সত্য। মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে তিনি বিশাল অবদান রেখেছেন। তাঁর সেই অবদানের স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন। সুতরাং তাঁকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তালিকাভূক্ত করে প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা দেওয়া উচিত।
রুপতেরা বিবির বয়স হয়েছে। নানা রোগে কাবু তিনি। তবু ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে জীবনকে সচল রেখেছেন। তাঁর প্রত্যাশা, সরকার তাকে মুক্তি দিন। তিনি ভিক্ষাবৃত্তি না করে যুদ্ধাহত তালিকায় ভাতা পাওয়ার প্রত্যাশি তিনি। মাথাগোঁজার মতো একটি ঘরও তাঁর খুব প্রয়োজন।
পরিশেষে দু:খভরা হ্রদয় নিয়ে বলতেই  হচ্ছে, যেখানে ভুয়া লোকেরা মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে! সেখানে জীবনবাজী রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী মুক্তিযোদ্ধারা তালিকাভুক্ত হতে পারছেনা। এ লজ্জা কার। যুদ্ধ করার পরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা শুধু ডকুমেন্টের অভাবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারছেননা। সেখানে কিভাবে ভুয়া লোকেরা মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *