তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় করা মামলায় সঙ্গে সঙ্গে আসামী গ্রেফতার হয়। ফরিদপুরে মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন পঙ্গু সাংবাদিক প্রবীর শিকদার। পঙ্গু অবস্থায় সাংবাদিক প্রবীর শিকদারকে হাতে হাত কড়া পড়িয়ে নিয়ে যায় ডিএমপি পুলিশ। আর ঢাকা ডিবিতে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ফরিদপুরে। দেওয়া হয় ৩ দিনের রিমান্ড। ৪ দিনের মাথায় জামিন পান প্রবীর শিকদার। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে একই ধারায় মাদারীপুর থানায় সোমবার মামলা হয়। আজ মঙ্গলবার তিনি উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন লাভ করেন। জামিনের পাশাপাশি মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিলের পূর্ব পর্যন্ত তাকে জামিন দেয়া হয়।
বিস্তারিত বর্ননায় বলা যায়, ২০১৫ সালের ১৬ আগষ্ট রাতে রাজধানী শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ ঢাকা থেকে সাংবাদিক প্রবীর শিকদারকে গ্রেফতার করে ফরিদপুরে নিয়ে যায়। প্রায় একই সময় ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় তার বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে একটি মামলা হয়। আইসিটি আইনে ফরিদপুরের এপিপি স্বপন পাল বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। ফরিদপুর আদালতের বিচারক মোঃ: হামিদুল ইসলাম জামিন আবেদন নাকচ করে তার ৩ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন। ১৯ আগষ্ট তিনি জামিনে মুক্তি পান।
এর আগে, ২০১৫ সালের ১০ আগস্ট ফেইসবুকে প্রাণনাশের আশঙ্কা করে স্ট্যাটাস দেন প্রবীর শিকদার। এতে তিনি তার মৃত্যুর জন্য এলজিআরডিমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ধনকুবের মুসা বিন শমসের ও যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকার দায়ী থাকবেন বলে উল্লেখ করেন। ওই স্ট্যাটাসের বিষয়কে কেন্দ্র করে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। স্ট্যাটাসে তিনি তার মৃত্যুর জন্য এলজিআরডিমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ধনকুবের মুসা বিন শমসের ও যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকার দায়ী থাকবেন বলে উল্লেখ করেন। এ আশঙ্কায় থানায় জিডি করতে গেলেও তা নেয়নি পুলিশ।
প্রবীর শিকদার যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করে আসছিলেন। তিনি দেশের বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ তিনি বাংলা একাত্তর ও উত্তরাধিকার একাত্তরের সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
এদিকে ২০১৭ সালের আজকের দিনে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারায় করা মামলা ও মানহানির মামলায় আগাম জামিন পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল। মাদারীপুর সদর থানায় আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করা হয়। নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের ভাগনে সৈয়দ আসাদউজ্জামান মিনার এই মামলার বাদী। ২৪ নভেম্বর নৌমন্ত্রীর চাচাতো ভাই মাদারীপুর জেলা পরিষদের সদস্য খান ফারুক মাদারীপুর মুখ্য বিচারক মো. জাকির হোসেনের আদালতে আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করেন।
আদালতে উপস্থিত হয়ে আসিফ নজরুল আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন জানান। আদালতে আসিফ নজরুলের পক্ষে শুনানি করেন, আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ এ কে এম মনিরুজ্জামান কবীর।
মাদারীপুর সদর থানায় করা এই মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসিফ নজরুল তাঁর ফেসবুক পেজে চট্টগ্রাম বন্দরে লস্কর পদে (জাহাজের রশি বাঁধা ও পাহারা দেওয়াই যাঁদের মূল কাজ) নিয়োগ নিয়ে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য দিয়েছেন। আসাদউজ্জামান তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মাদারীপুর সদর থানায় আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আদেশের জন্য পাঠানো হয়।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ১৮ নভেম্বর আসিফ নজরুল চট্টগ্রাম বন্দরে লস্কর পদে নিয়োগ নিয়ে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দেন। সেখানে বলা হয়, এই পদে নিয়োগ দেওয়া ৯২ জনের মধ্যে ৯০ জনই মাদারীপুর জেলার বাসিন্দা। বিবরণে আরও বলা হয়, নৌমন্ত্রীকে নিয়ে যে স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে, তা ভিত্তিহীন। এখানে মোট ৮৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যাঁদের মধ্যে মাদারীপুর জেলার মাত্র ৮ জন রয়েছে।
গত মঙ্গলবার তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের করার জন্য নৌমন্ত্রীর ভাগনে আসাদউজ্জামান জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আবেদন করেন। তবে আদালত মামলাটি গ্রহণ করেননি। পরে বৃহস্পতিবার আসাদউজ্জামান আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মাদারীপুর সদর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। গতকাল সোমবার সকালে এটি মামলা হিসেবে নেওয়া হয়। একই ঘটনায় ২৪ নভেম্বর আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করা হয়।
মাদারীপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি তদন্ত) মো. আবু নাইম বলেন, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারায় মামলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, নৌমন্ত্রীকে নিয়ে ফেসবুকের ওই পোস্ট তাঁর নামে করা ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া হয়েছিল। ওই ভুয়া অ্যাকাউন্টের বিষয়ে ফেসবুকে তিনি বিভিন্ন সময়ে সবাইকে সতর্ক করেছেন।
তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে দেশব্যাপী সমালোচনা ও মানববন্ধনও হয়েছে। ধারাটি বাতিলের জন্য সব দিক থেকে দাবী উঠার পর সরকার বলেছে, ধারাটি বাতিল করা হবে। কিন্তু সহজেই প্রশ্ন এসে যায়, ৫৭ ধারার মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন পঙ্গু সাংবাদিককে হাতে হাতকড়া পরিয়ে ঢাকা থেকে ফরিদপুর নিয়ে যায় পুলিশ। দেয়া হয় রিমান্ডও। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক একই ধারায় মামলার আসামী হয়ে গ্রেফতার না হয়েও উচ্চ আদালতে গিয়ে চার্জসিট দাখিলের পূর্ব পর্যন্ত জামিন লাভ করেন।
তাই জাতির কাছে প্রশ্ন আসতেই পারে, একই আইনের একই ধারার মামলা এক এক সময় এক এক ভাবে প্রয়োগ করা হল। কারো ক্ষেত্রে আগাম জামিনের সূযোগ করে দেয়া, আবার কারো ক্ষেত্রে ফরিদপুরে মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা। তাহলে কি সাংবাদিক এমনকি পঙ্গু সাংবাদিকদের জন্যও আইনের প্রয়োগ শিথিলযোগ্য হবে না!
একটি রাষ্ট্রের সকল নাগরিককে একই মানদন্ডে বিচার করা উচিত। কারো ক্ষেত্রে কম, কারো ক্ষেত্রে বেশী, এমনি হলে আইনের শাসন বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হবে এটাই স্বাভাবিক।
জাতি আশা করে, আইন মুখ চিনে যেন প্রয়োগ করা না হয়, সেদিকে সরকারকে সতর্ক থাকা দরকার।
ড. এ, কে এম রিপন আনসারী
এডিটর ইনচীফ
গ্রামবাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম