“বাবা ”শব্দটি সার্বজনিন হলেও ওরসদাতা হিসেবে একটি ভিন্ন পরিচিতি থাকে তবে সকলের পিতাকে বাবা বলতে সমস্যা নেই। সেকাল-একালের সংঘর্ষে বাবা শব্দটি ভেঙে চূরমার হলেও মৌলিক শব্দের অর্থগত কোন পার্থক্য নেই। যার বাবা আছেন, তিনি তেমন করে উপলব্ধি করতে পারবেন হয়ত কম। আর যার নেই, তিনি বুঝতে পারেন বাবা কাকে বলে। বাবাকে বাবা মনে করতে না পারা, আমাদের নৈতিক দায়ের অধঃপতন বলা যায়। আমরা যারা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত দাবী করছি, তারা ভাবছি না এই দাবীর দাতা কে? আমরা মাঝে মাঝে ভুলে যাই, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নেপথ্যের দাতাকে । নিজের বা অন্যের বাবাকে অপমান করতেও আমরা দ্বিধা করছি না। এমনটি হয়, যখন মানুষ, অমানুষের আবরণে ডুবে যায়। সন্তানের হাতে বাবা খুন আর বাবার বয়সী কাউকে খুন বা অপমান করার রীতি চলমান। যদিও এটা গুরুতর অপরাধের মধ্যে পরে তবুও কিছু অমানুষ বাবা শব্দটিকে ধ্বংস করে দিয়ে নতুন নতুন অমানবিক ইতিহাস তৈরী করতে চায়। আমরা মানবতার ইতিহাস কে কলংকিত নয় ভুলুন্ঠিত করে অমানবিক ইতিহাসও রচনা করার চেষ্টা করছি। জাতির এই পশুত্বভাব কেটে যাক প্রত্যাশাটা মানুষ ও অমানুষ সকলেরই কাম্য হওয়া উচিত।
আজ সকাল সাড়ে ৮টায় গাজীপুর শহরের পৌর মার্কেটের সামনে সোহেলের চায়ের দোকানে খালি পেটে এক কাপ রঙ চা খাওয়ার জন্য ফুটপাতের দ্বারে চায়ের স্টলের বেঞ্চে বসলাম। হালকা শীতের মৃদু সকালে উদয়মান সূর্যের আলোর মিষ্টি রোদে চা খাওয়ার মজা, নতুন কোন আমেজ নয় বরং পুরাতন। ঠিক ওই সময় ফুটপাত দিয়ে লাঠিভর করে নিজের সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্চ করে হেঁটে হেঁটে ভিক্ষা করছেন এক বয়স্ক মানুষ। বয়সের ভারে নুব্জ্য ওই ব্যাক্তির বোধ শক্তি এমন যে, আশে পাশে কেউ যাচ্ছেন কি না, বা ফুটপাতের মাঝস্থান দিয়ে তার ধীরে ধীরে হেঁটে চলার কারণে পাথচারীদের যাতায়াতে অসুবিধা হচ্ছে কি না, তাও জানার দরকার ছিলনা তার। কারণ সেই বোধ শক্তির বয়স তার পেরিয়ে গেছে তাই। আমার চা খাওয়া আর ভিক্ষারী বাবার পথচলা, হঠাৎ আমার চোখের পলককে থমকে দিল। এক সময় দেখলাম, মানুষ চা খাচ্ছেন আর তিনি অসহায়দৃষ্টিতে নির্বাকের মত ভাজপড়া দেহের চামড়ায় লুকানো ছোট ছোট ছানাভরা চোখে মিটি মিটি করে একটি চা খাওয়ার আকুতি ছুঁড়ে দিচ্ছেন আকাশের ঠিকানায়। যারা স্টলে দাঁড়িয়ে বা বসে চা খাচ্ছেন, তাদের কারো দৃষ্টি ওই ভিক্ষারী বাবার দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। এমন সময় হঠাৎ অনুসন্ধানী চোখের এক পলক দৃষ্টি পড়ে যায় ভিক্ষারী বাবার চোখের দিকে। সাথে সাথে তাকে ধরে চায়ের স্টলের একটি টোলে বাসানোর জন্য ফুটপাত থেকে আস্তে আস্তে আনতে থাকি। এমন সময় ঘটে গেল এক ঘৃন্যকান্ড। ভিক্ষারী বাবাকে আনতে গিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা মাঝ বয়সী দুই নারী ফুটপাত দিয়ে যাওয়ার সময় বাবার বয়সী ওই ভিক্ষারীকে দেখে নাকে হাত দিয়ে ফুটপাত ছেড়ে বাঁকা পথে চলে গেলেন।
দৃশ্যটা তৈরী হল এই ভাবে যে, একজন বয়স্ক মানুষের দেহের দুর্গন্ধ, তাদের নাকে গিয়ে যে কোন অসুখ সৃষ্টি করতে পারে, আশংকায় তারা ফুটপাত ছেড়ে অন্য পথে দ্রুত চলে গেলেন। ভাবতে অবাক লাগে নি আমার, কারণ প্রায় দেড় যুগের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেননি ওই দুই নারী। তবে বিনা কথায় ষ্পষ্টভাবেই বৃদ্ধ লোকটিকে অপমান, অসম্মান ও ঘৃনা করার অমানবিক কাজটি নিঃশব্দে করে ফেলেছেন ওই দুই মমতাময়ী নারীর জাত, এটা সঠিক।
এখানে বলে রাখা দরকার যে, ওই দুই নারীর গায়ে একই ধরণের যে পোষক পরিহিত ছিল, সেই পোষাক, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকেরা যখন পিটিআই ট্রেনিং করেন, তখন পরিহিত থাকে। তাই পোষাক যদি সঠিক জায়গায় আবৃত থেকে থাকে, তবে বৃদ্ধকে দেখে নাকে ধরে ফুটাপাত ছেড়ে যাওয়া ওই দুই নারী, শিক্ষক হবেন এটা ঠিক। আর যদি তারা শিক্ষকই হয়ে থাকেন, তবে তারা কি শিক্ষা দিচ্ছেন, সেটা আর বলার প্রয়োজন নেই। পাঠকেরাই বলবেন।
যাই হউক, ভিক্ষারী বাবাকে সামনে বসালাম। এক কাপ চা দিলাম। ততক্ষনে আমার চা খাওয়া শেষ। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছি বৃদ্ধ লোকটি কি ভাবে যত্ন করে চা-টি খাচ্ছেন। আমার মনে হল, তার চা খাওয়ার নেশা, তার সর্বোচ্চ চাহিদা বিরিয়ানী খাওয়ার স্বাদ-আহলাদকে হারিয়ে দিয়েছে।
এমন সময় আমার মনে হল, আমি শিশুকালে বাবাকে হারিয়েছি। হিসেব করে দেখলাম আমার বাবা বেঁচে থাকলে এই বৃদ্ধ বাবার মতই হতেন! তখন ভাবতে গিয়ে কিছু সময়ের জন্য শিশুকালে চলে গেলাম অনেক দূর হেঁটে পেছনের জীবনে। ভাবলাম, আমার বাবা যদি বেঁচে থাকতেন আর আমি যদি বাবার আগে মরে যেতাম, তখন আমার বাবা এমনো হতে পারতেন? হয়তবো নাও হতে পারতেন। এই ভেবে অবনতমস্তকে মাটির দিকে কিছুক্ষন চেয়ে রইলাম।
অতঃপর ভিক্ষারী বাবাকে জিঞ্জেস কললাম উনার নাম কি? ঠিকানা কি? বিস্তারিত। উনি যা বললেন, তা হল, উনার নাম মনহর আলী শেখ। বয়স ৮৫/৯০। আদিবাড়ী নেত্রকোনা জেলার বারহাট্রা থানার পুটিয়া গ্রামে। ১৯৭১ সালে তার বুকে ক্যান্সার হয়েছে। চিকিৎসা করতে গিয়ে ভিটেমাটি সব খুঁইয়েছেন তিনি। এখন গাজীপুর মহানগরের ধীরাশ্রম বাজারের পশ্চিম পাশে জনৈক রমিজ মিয়ার বাসায় মাসে এক হাজার টাকা ভাড়ায় থাকেন তিনি। তার দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এক ছেলে ছিল, সে মারা গেছেন। এখন মৃত ছেলের দুই শিশু সন্তান ও নিজের স্ত্রী সহ তিনি ৪ সদস্য নিয়ে সংসার করছেন। সারাদিন ভিক্ষে করে যা পান, তা দিয়েই চলে সংসার। কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে চলছে ভিক্ষারী বাবা মনহর শেখের চলমান জীবন। প্রতিমুহূর্তেই তিনি যুদ্ধ করছেন নিজের সঙ্গে, বাস্তবতার সঙ্গে, মনবতার সঙ্গে আর আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে অভিশাপ দিচ্ছেন অপমানিত হয়ে।
মনহর শেখের বুক খোলে দেখলাম বুকটা অনেক ভেতরে চলে গেছে। বিভৎস গর্তে ঢুকে যাওয়া বুক সমেত দেহের অধিকারী মনহর আলী প্রায় ৪৫ বছর ধরে ক্যান্সার রোগ নিয়ে ভিক্ষা করতে করতে বেঁচে আছেন। আমাদের সমাজে ক্যান্সার হলে বিপুল পরিমান টাকা ব্যয় করেও আমরা বাঁচতে পারছি না। আর মনহর আলী ৪৫ বছর ধরে ক্যান্সার রোগবহন করে বিনা চিকিৎসায় ঘুরছেন, ভিক্ষে করছেন, না খেয়েও থাকছেন, তবুও ক্যান্সার তাকে হার মানাতে পারছে না। ৯০ বছরের ভিক্ষারী বাবা মনহর আলী শেখ, ক্যান্সারকেই শুধু হার মানিয়েছেন তা নয়, ওই দুই মমতাময়ী মায়ের বিভৎস আচরণ ও আমাদের গুনেধরা সমাজ ব্যবস্থাকেও হারিয়ে দিয়েছেন। যে সমাজ ব্যবস্থায় সন্তান বাবাকে খুন করে, আর বাবার বয়সী মানুষকে সন্তানের বয়সী অপরাধীরা অপমান করে, হত্যা করে।
আমাদের সেই দিন কি কখনো আসবে? যখন আমরা মনহর আলী শেখের মত মানুষদেরকে মানবতার চাঁদরে ঢেকে দিয়ে “বাবা” শব্দটির যথার্থ মর্যাদা দিতে পারব? আসুক বা নাই আসুক, আশাবাদী মানুষ আমরা। আশা ছাড়তে নারাজ। একদিন না একদিন আমরা “বাবা” শব্দটিকে যথাযথ সম্মান দিতে শিখব, এই শুভকামনা রইল।
ড. এ কে এম রিপন আনসারী
এডিটর ইনচীফ
গ্রামবাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম