সরকার গুণগত মানের বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না। লোডশেডিংয়ের সময় তেলভিত্তিক জেনারেটরের মাধ্যমে (ক্যাপটিভ পাওয়ার) বিদ্যুৎ উৎপাদন করে শিল্পকারখানা চালু রাখতে হচ্ছে। এতে শিল্পের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে রফতানি আয়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে রফতানি কমে গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ অবস্থানে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের আরেক দফা দাম বাড়ানোর ফলে শিল্পের সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রফতানি আয়ের ওপর। দুর্ভোগ বাড়বে সাধারণ ভোক্তাদের।
বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর প্রতিক্রিয়া এভাবেই প্রকাশ করেছেন রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম মুর্শেদী। গতকাল নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে সালাম মুর্শেদীর কাছে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি এ কথা বলেন।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে জনগণের ঘাড়ে কয়েক গুণ ব্যয় বেড়ে যাবে বলে জানিয়েছেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম। তিনি পরিসংখ্যান দিয়ে জানান, বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বা ইউনিটে ৩৫ পয়সা বাড়ানোর ফলে সরকার জনগণের পকেট থেকে সরাসরি নেবে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সরকার এ দুই হাজার কোটি টাকা আয় করতে গিয়ে জনগণের ঘাড়ে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ব্যয়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে।
তিনি এর ব্যাখ্যা করে জানান, ৩৫ পয়সা ইউনিটে দাম বাড়ানোর ফলে সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে বাড়তি মূল্যে গ্রাহকদের পণ্য কিনতে হবে। এভাবেই ব্যয় বেড়ে যাবে ভোক্তাদের। যাদের সামর্থ্য আছে তারা হয়তো বাড়তি দামে কিনতে পারবেন। কিন্তু যাদের সামর্থ্য নেই তাদের নির্ধারিত আয় দিয়ে চাহিদার চেয়ে কম পণ্য কিনতে হবে। কম ভোগ করে বাড়তি ব্যয় সমন্বয় করবেন সাধারণ ভোক্তারা। তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়েও সরকার বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় কমাতে পারত। তিনি মনে করেন, বিদ্যুৎ খাতের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে পারলে গ্রাহকদের ওপর বাড়তি ব্যয়ের বোঝা চাপিয়ে দিতে হতো না।
বাংলাদেশ অটোরিরোলিং ও স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করেছে। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করেনি সরকার। প্রায় প্রতিটি দেশই জ্বালানি তেলের পাশাপাশি ডলারের মূল্য সমন্বয় করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে ডলারের মূল্য সমন্বয় করা হয়নি। এতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশী পণ্যের মূল্যের প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে। বাংলাদেশী পণ্যের জায়গা দখল করছে অন্য দেশের পণ্য। এখন আবার হঠাৎ করে ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ৬৮ টাকার ডলার এখন প্রায় ৮৪ টাকায় উঠে গেছে।
এমনি পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। শিল্পের প্রতিটি খাতের সাথে বিদ্যুৎ জড়িত। এখন বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতিটি পণ্যের দামই বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ী ও দেশের জনগণের রক্ত দিয়ে কিছু কর্মকর্তার বোনাস দেয়ার জন্য সরকারের বিদ্যুতের দাম বাড়ানো মোটেও যুক্তিসঙ্গত হয়নি। শিল্পায়নবিরোধী এ সিদ্ধান্ত জনগণকে চরম দুর্ভোগের মধ্যে ফেলবে।
ভোক্তা, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে যখন জনগণের দুর্ভোগের কথা বলছেন তখন সরকারের প্রতিনিধিরা বলছেন ভিন্ন কথা। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বিদ্যুতের যে দাম বাড়ানো হয়েছে, এটি খুবই সামান্য ও মামুলি ব্যাপার। জনজীবনে এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করি না। বিইআরসি নিজস্ব বিবেচনা থেকে দাম বাড়িয়েছে, এ ক্ষেত্রে আমাদের কোনো প্রভাব নেই। সমালোচক বা নিন্দুকেরা এ নিয়ে সমালোচনা করলেও দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক নয়। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও সরকারকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে বলে তিনি দাবি করেন।
আর বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছেন, প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে গড়ে ১৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছিল; কিন্তু তা করা হয়নি। তিনি বলেন, যেকোনো মূল্য সমন্বয়েরই কমবেশি প্রভাব থাকে। তাহলে যে হারে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি হয়েছে তা খুব বেশি কিছু নয়। তবুও হয়ত গ্রাহকপর্যায়ে কিছুটা প্রভাব পড়বে। কিন্তু সেটি সহনীয় এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ব্যবসায়ী, গ্রাহক ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের বিরোধিতার পরেও আবারো গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে এবার অষ্টম দফায় প্রতি ইউনিটে দাম বাড়ানো হয়েছে ৩৫ পয়সা। এ মূল্য আগামী ১ ডিসেম্বর থেকেই কার্যকর হবে।