প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশস্ত্র বাহিনীর উদ্দেশে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে। সশস্ত্র বাহিনীকে জনগণের পাশে থেকে তাদের কল্যাণে কাজ করতে হবে।
’ একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা আগামী জানুয়ারি মাস থেকে ভাতা পাবেন।
স্মৃতিচারণা করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে আমাদের সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধন রয়েছে। আমার ভাই শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয় ভাই শহীদ লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল ১৯৭৫ সালে রয়েল মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্সট্স থেকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ শেষে কমিশন লাভ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ছোট ভাই রাসেলেরও ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার। সে সেনাবাহিনীর সুশৃঙ্খল কার্যক্রম দেখে অত্যন্ত উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু ঘাতকের নির্মম বুলেট তার ছোট্ট বুকটা বিদীর্ণ করে দেয়। ’
সশস্ত্র বাহিনী দিবস-২০১৭ উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে সেনাকুঞ্জে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এর আগে সকালে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা/উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকার আগামী জানুয়ারি মাস থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যেককে ভাতা প্রদান করবে।
’
দিবসটি উপলক্ষে গতকাল সকালে স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা সেনানিবাসের শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে পৃথকভাবে গার্ড অব অনার প্রদান করে। পরে তাঁরা শিখা অনির্বাণে রক্ষিত পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে শিখা অনির্বাণে স্বাগত জানান তিন বাহিনীর প্রধানগণ এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার। মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাতবরণকারী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের স্মরণে তিন বাহিনীর প্রধানরাও নিজ নিজ বাহিনীর পক্ষ থেকে সম্মিলিতভাবে শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
বিকেলে সেনাকুঞ্জের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বমানের শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, খেলাধুলা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান অর্জনের মধ্য দিয়ে আমাদেরকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করাতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সবার সহযোগিতা ও ঐকান্তিক ইচ্ছা। আশা করি, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের কর্মে পেশাদারিত্বের মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদা সমুন্নত করবেন এবং জাতীয় উন্নয়নে তাঁদের ভূমিকা অব্যাহত রাখবেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত সশস্ত্র বাহিনী আমাদের জাতির অহংকার। আমি আপনাদের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করি। আপনারা যেন চেইন অব কমান্ড মেনে শৃঙ্খলা ও পেশাগত দক্ষতায় সর্বত্র প্রশংসিত হতে পারেন সেটাই আমার কাম্য। ’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনী সততা, নিষ্ঠা, কর্মদক্ষতা ও নানা জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি যেকোনো দুর্যোগকবলিত অঞ্চলে আর্ত-মানবতার সেবা ও জানমাল রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনী যে আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে বিপর্যস্ত জনগণের পাশে দাঁড়ায় তা জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ রাখবে। ’ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের সহায়তায় সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকাও দেশ-বিদেশে বহুল প্রশংসিত হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকী এবং তিন বাহিনীর প্রধানগণ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা, জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার খান মো. নুরুল হুদা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা ও তাঁদের স্ত্রী, কূটনীতিক এবং পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা সংবর্ধনায় অংশ নেন। তবে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর কোনো নেতাকে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি।
বিকেলের ওই সংবর্ধনায় যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী সেনাকুঞ্জে এসে পৌঁছলে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল আবু এসরার এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাহফুজুর রহমান সস্ত্রীক তাঁকে স্বাগত জানান।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছিলেন। এটাই ছিল স্বাধীনতার মূল চেতনা। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই ঘাতকরা তাঁকে হত্যা করে এবং বিজয়ী জাতির মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করে। ’ তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে ইউনেসকোর স্বীকৃতি প্রদানে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হয়েছে। ’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করলেও ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে না পারায় সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেমে যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে পুনরায় উন্নয়নের নব দিগন্ত উন্মোচিত হয় এবং জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও সেই থেকে অব্যাহত রয়েছে। ’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে প্রণীত প্রতিরক্ষা নীতিমালার আলোকেই ফোর্সেস গোল-২০৩০ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর আওতায় তিন বাহিনীর পুনর্গঠন ও আধুনিকায়নের কার্যক্রমগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর আধুনিকায়নে তাঁর সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর অংশবিশেষ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সুদৃঢ়করণ এবং সেনাবাহিনীর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে বেশ কিছু ব্রিগেড ও ইউনিট প্রতিষ্ঠা করে। আমরা সিলেট ও রামুতে পূর্ণাঙ্গ পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করেছি। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালীতেও শিগগিরই একটি নতুন পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি। ’
বিভিন্ন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যরা ভাতা পাবেন : বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী গতকাল সকালে ঢাকা সেনানিবাসের মাল্টিপারপাস হলে আয়োজিত খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা/উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা, বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, আনসার-ভিডিপি ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (তৎকালীন ইপিআর) সদস্য যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তাঁদের ভাতা প্রদান করা হবে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তাঁরা তখন বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন বলে সে সময়ে তাঁদের ভাতা প্রদান করা হয়নি। তাঁদের প্রায় সবাই এখন অবসরে এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও সমস্যায় রয়েছেন। আমরা তাঁদের সবাইকে আগামী জানুয়ারি থেকে ভাতা প্রদান করব। ’
সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাহফুজুর রহমান এ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী সাত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার এবং মুক্তিযুদ্ধে সম্মাননা পদকপ্রাপ্তদের মধ্যে সম্মানী চেক ও উপহার বিতরণ করেন। এ ছাড়া তিনি ‘শান্তিকালীন পদক-২০১৬’ বিজয়ী ১২ জন এবং ‘অসামান্য সেবা’ পদক বিজয়ী ১৪ জনসহ সশস্ত্র বাহিনীর ২৬ সদস্যের মধ্যে পদক বিতরণ করেন।