পৃথক দুটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা মুসলিমদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা, নারী ও শিশুদের গণধর্ষণ ও ধর্ষণপূর্বক হত্যা এবং হত্যার পর লাশ স্তূপ করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়াসহ ভয়ংকর ও বর্বর এক গণহত্যার চিত্র পাওয়া গেছে। প্রতিবেদন দুটিতে এসব নৃশংসতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
গতকাল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) রোহিঙ্গাদের ওপর যৌন সহিংসতা ও নৃশংসতা বিষয়ক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
অপর প্রতিবেদনটি যৌথভাবে প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হত্যাযজ্ঞবিষয়ক গবেষণা-আর্কাইভ প্রতিষ্ঠান ‘ইউনাইটেড স্টেট হলোকস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়াম’ (ইউএসএইচএমএম) ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘ফর্টিফাই রাইটস’।
মানবাধিকার সংস্থা এইচআরডাব্লিউয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, সামরিক অভিযানের সময় মিয়ানমারের সেনারা রোহিঙ্গা নারী ও মেয়ে শিশুদের অসংখ্যবার গণধর্ষণ করেছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী যে ধরনের যৌন সহিংসতা ও অন্যান্য নৃশংসতা চালিয়েছে, তার পরিমাণ মানবতাবিরোধী অপরাধের সমান।
গণধর্ষণের পর বেঁচে যাওয়া (রেপ সারভাইভর) রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এইচআরডাব্লিউয়ের প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করতে ৫২ জন রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়।
এর মধ্যে ২৯ জন হচ্ছে ‘রেপ সারভাইভর’, যাদের মধ্যে ১৮ বছরের নিচে তিনটি মেয়ে রয়েছে। উত্তর রাখাইনের ২৯টি গ্রাম থেকে এই ৫২ জন বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এই ২৯ জনের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সবাই দুইবার বা তার চেয়ে বেশি গণধর্ষণের শিকার হয়।
তাদের মধ্য আটজন নারী ও কিশোরী পাওয়া গেছে, যারা পাঁচ বা তার চেয়ে বেশি সৈনিকদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে।এসব নারী বলেন, সেনারা তাঁদের ধর্ষণ করার আগে তাঁদের ছোট ছোট শিশু, স্বামী বা মা-বাবাকে হত্যা করেছে। তাঁরা বলেন, পর পর ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর ক্ষত-বিক্ষত জননাঙ্গে রক্তপাত ও তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করেই তাঁরা দীর্ঘ পথ হেঁটে বাংলাদেশে এসেছেন। এমন ছয়টি ঘটনা পাওয়া গেছে, যেখানে মেয়েদের জড়ো করে পেটানো হয়েছে, তার পরও গণধর্ষণ করা হয়েছে।
৩৩ বছর বয়সী মমতাজ ইউনিস নামের এক নারী বলেন, তিনিসহ ২০ জন নারীকে সেনারা একটি পাহাড়ের কিনারায় আটকে ফেলে। পালিয়ে বাঁচার জন্য তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন। সেনারা ওই নারীদের প্রকাশ্যে ধর্ষণ করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গবেষক ও প্রতিবেদন লেখক স্কাইয়ি হুইলার বলেন, ‘অভিযানে ধর্ষণ করা বার্মিজ সেনাদের সুপরিচিত ও ভয়ংকর বৈশিষ্ট্য। ’
যুক্তরাষ্ট্রের হলোকস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়াম ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানবাধিকার সংস্থা ‘ফর্টিফাই রাইটসের’ প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ৯ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এবং চলতি বছরের গত ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত দুই পর্বে রোহিঙ্গা বেসামরিক লোকদের ওপর মিয়ানমার বাহিনীর অভিযান ছিল ‘ব্যাপক মাত্রা ও সুপরিকল্পিত আক্রমণ’। ৩০ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছে ‘আমাদের সবাইকে তারা হত্যা করতে চেয়েছিল’। নৃশংসতার পর বেঁচে যাওয়া ও প্রত্যক্ষদর্শী ২০০ রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
ইউএসএইচএমএম ও ফর্টিফাই রাইটসের সংগ্রহ করা সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা গেছে, মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী ও তাদের সহযোগী বেসামরিক বৌদ্ধ অপরাধীরা সম্মিলিতভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও জাতিগত নিধন অভিযান পরিচালনা করেছে। গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর ও চলতির বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে দুটি পর্বে এই অপরাধ সংঘটিত হয়। ‘গণনৃশংসতার একটি পদ্ধতিগত অভিযান’ ছিল এটি।