দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ইতিবাচক। প্রধান প্রধান সূচকের উন্নতি হচ্ছে। তবে কিছু ঝুঁকি আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া এবং মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া।
ব্যবসায়ীদের প্রভাবশালী সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) তাদের ত্রৈমাসিক পর্যালোচনায় এসব কথা বলেছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক, অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে এমসিসিআইয়ের এ পর্যালোচনা গতকাল সোমবার প্রকাশ করা হয়। প্রতি তিন মাস পরপর এ ধরনের পর্যালোচনা করে সংগঠনটি।
এবারের পর্যালোচনায় এমসিসিআই বলেছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে দেশের কৃষি, উৎপাদনশীল ও সেবা খাত ভালো করেছে। এ ধারা ধরে রাখতে সরকারের সহায়তা দরকার। এমসিসিআই বরাবরের মতো এবারও বলেছে, দেশের অর্থনীতি সত্যিকার সম্ভাবনা অনুযায়ী এগোতে পারছে না। অবকাঠামো ঘাটতি এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় উৎপাদনশীল খাতের অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে।
বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি ও উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য রাস্তাঘাট, রেলওয়ে, বন্দর, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সার্বিক অবকাঠামোর উন্নতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করা এবং তা বজায় রাখা দরকার বলে আবারও উল্লেখ করা হয় এমসিসিআইয়ের পর্যালোচনায়।
সংগঠনটি যে তিনটি বিষয়কে ঝুঁকির তালিকায় রেখেছে, তার মধ্যে প্রথমে আছে প্রবাসী আয়ের কথা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৭৬ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে সাড়ে ১৪ শতাংশ কম। এ নিয়ে এমসিসিআইয়ের পর্যালোচনায় বলা হয়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় ৩৩৯ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি। এ বৃদ্ধির কারণ প্রান্তিকের প্রথম দুই মাসে আয় অনেক বেশি হয়েছিল। তবে সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এমসিসিআই বলছে, এ পতনের কারণ মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর দুর্বল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। সম্প্রতি তেলের দাম কিছুটা বাড়লেও এসব দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অবৈধ পথে প্রবাসী আয় আসছে বলেও উল্লেখ করা হয় পর্যালোচনায়। এতে আরও বলা হয়, অক্টোবর মাসে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি সরকারের জন্য সুখবর। এটা সম্ভব হয়েছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে।
রপ্তানি খাত নিয়ে এমসিসিআইয়ের পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে পণ্য রপ্তানি করে প্রায় ৮৬৬ কোটি ডলার আয় হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। অবশ্য এই আয় আলোচ্য সময়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৮৪ শতাংশ কম। রপ্তানি খাত-সংশ্লিষ্টদের বরাত দিয়ে এমসিসিআই বলেছে, পোশাক খাতে নিরাপদ কর্মপরিবেশের ক্ষেত্রে উন্নতি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ থাকায় রপ্তানি আয় বেড়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে পর্যালোচনায় বলা হয়, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ১২ শতাংশ, যা বিগত দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার জন্য এমসিসিআই কিছু খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
পর্যালোচনায় সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এমসিসিআই অর্থনীতির প্রায় সব খাতের অবস্থা তুলে ধরেছে। এতে দেখা যায়, রাজস্ব আয়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন, বৈদেশিক সাহায্যের ব্যবহার, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ, আমদানি ইত্যাদি বেড়েছে। অন্যদিকে বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি বেড়েছে এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে।
পর্যালোচনায় জানানো হয়, আর্থিক খাতের মধ্যে ব্যাপক মুদ্রার সরবরাহের প্রবৃদ্ধি কমেছে এবং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। আমানতের সুদের হার কিছুটা বেড়েছে এবং ঋণের সুদের হার কিছুটা কমেছে। শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি ইতিবাচক বলে উল্লেখ করা হয় পর্যালোচনায়।
এমসিসিআই মনে করে, দেশে যে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা সামনের দিনগুলোতে অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি রপ্তানি, আমদানি ও প্রবাসী আয় বাড়বে। সংগঠনটির প্রাক্কলন অনুযায়ী, অক্টোবরের হিসেবে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এরপর সেটা কমতে পারে।