এ দেশে একটি দিনও মনে হয় শান্তিতে যাবে না। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার হিন্দু গ্রামে হামলার ঘটনার একটিই নাম: প্রকাশ্য বর্বরতা। যাদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে, তারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পরোক্ষভাবে আমরা সবাই আক্রান্ত বোধ করেছি। গুম-অপহরণের নতুন এক সারি ঘটনার ধাক্কা চলছে জাতীয় জীবনে। প্রতিকারহীন এ অন্যায় যখন দেশের ওপর ভয়ের চাদর বিছাচ্ছে, তখন হিন্দু সমাজের কয়েকটি বাড়ি পোড়ানোর দৃশ্য নতুন করে আমাদের মুষড়ে দিল।
কিন্তু এ আগুন তো হঠাৎ জ্বলেনি। সময় নিয়ে, জানান দিয়ে, মামলা করে, খুব গোছানো পদ্ধতিতে মোক্ষম সময়ে শত শত মানুষ এসে এ আগুন ধরিয়েছে। সুতরাং একদিক থেকে এ রকম হামলার আশঙ্কাই বরং জোরালো ছিল। হামলার এই নকশা হুবহু মিলে যায় রামু, সাঁথিয়া, নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জের আগুনের সঙ্গে। কোনো ব্যতিক্রম নেই। সবখানেই ধাপে ধাপে পরিস্থিতি তৈরি করে, প্রশাসনের নাকের ডগায় সবকিছু করা হয়েছে। প্রশাসন চাইলে আরও আগেই বলতে পারত ‘খামোশ’! বলেনি কেন, সেটাই রহস্য।
গঙ্গাচড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলেছেন, হঠাৎ করে উপজেলার শলেয়া শাহ, বালাপাড়াসহ আরও কয়েকটি এলাকার কয়েক হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ সমবেত হয়ে বিক্ষোভ করে। ৫ নভেম্বর মামলা হলো, কয়েক দিন প্রচার হলো, ১০ নভেম্বর সকাল থেকে উসকানি চলল, আর ওসি বলছেন ‘হঠাৎ করে’?
পুলিশ মাঠে নামল ১০ নভেম্বর, আগুন লাগানোর পর। তখন আর পরিস্থিতি সামলাতে বেগ পেতে হয়নি তাদের। কিন্তু এর মধ্যে পুড়ে গেছে আটটি ঘর এবং নিহত হয়েছেন একজন কৃষক হাবিবুর রহমান। তিনি আক্রমণকারী বা আক্রমণের টার্গেট গোষ্ঠীর কেউ ছিলেন না; ছিলেন একজন উৎসুক দর্শক। গ্রামীণ মানুষের নিরীহ উৎসাহ তাঁর বেলায় প্রাণঘাতী হলো।
কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা দায়ী নয়। বাসে-ট্রেনে কিছু হারালে ‘কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না’ লেখা দেখে আমরা আপত্তি করি না। কিন্তু প্রকাশ্যে জনবসতিতে দস্যুতার আগুন ঠেকানোর ব্যর্থতার দায় তো কাউকে না কাউকে নিতেই হবে। জান-মাল রক্ষার জন্যই তো আমরা রাষ্ট্র গড়ে তুলেছি, তাই না?
আমরা নজর টানতে চাইছি ৫ থেকে ১০ নভেম্বর সময়টার ওপর। যাঁরা মানুষকে উসকিয়েছেন, তাঁরা অজ্ঞাতপরিচয় কেউ নন। রামু-সাঁথিয়া-নাসিরনগর-গোবিন্দগঞ্জের ঘটনার পথনকশা তো তাঁদের জানা ছিল। বরাবরের মতো এবারও দেখা গেল যে ফেসবুকের পোস্ট থেকে এত কিছু, তার হদিস কেউ জানে না। কিন্তু কেন? কার উদ্দেশ্য হাসিল হলো এতে? সাঁথিয়ার ঘটনার পেছনে ছিল ক্ষমতাসীন দলের দুই নেতার কোন্দল; গঙ্গাচড়ার ঘটনার পেছনে তাহলে কাদের হাত?
সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থেকে করা হামলাগুলোকে দাঙ্গা বলা যায় না। দাঙ্গার জন্য দুটি পক্ষ লাগে, আরও বড় এলাকাজুড়ে সহিংসতা ঘটানো হয়। দুটি সম্প্রদায়ের বিরাটসংখ্যক মানুষকে অল্প সময়ের জন্য হলেও দাঙ্গাবাজদের সমর্থন করতে দেখা যায়। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের নামে করা হামলাকারীদের প্রতি সংখ্যাগুরু সমাজেরই সমর্থন নেই। দ্বিতীয়ত, ঘটনাগুলো একটি-দুটি গ্রাম বা পাড়ার মধ্যেই সীমিত। তৃতীয়ত, দুটি সম্প্রদায়ের দুটি পক্ষের বদলে (রংপুরে বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বা পাবনার সাঁথিয়ায়) দেখা যাচ্ছে, কয়েক শ দুষ্কৃতকারী বনাম অসহায় কয়েকটি সংখ্যালঘু পরিবার।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গোষ্ঠীগত হামলার আরেকটি চরিত্র খুব নজর কাড়ে। প্রায় সব ঘটনাতেই হামলাকারীরা আসছে বাইরে থেকে। রামু-সাঁথিয়া-নাসিরনগর সবখানেই একই চিত্র, একই নকশা। এই বহিরাগতরা হয় ভাড়াটে, নয়তো মিথ্যা গুজবে বিশ্বাস করা উন্মাদ। যাদের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য তাদের আনা হয়েছে, তাদের তারা চেনে না, তাদের সম্পর্কে কিছু জানেও না।
প্রতিটি ঘটনায় স্থানীয় মুসলমান প্রতিবেশীদের দেখা গেছে হয় রক্ষাকারী নয়তো আশ্রয়দানকারীর ভূমিকায়। ১০ নভেম্বর দুপুরের হামলার পর আক্রান্ত হিন্দুরা পাশের গ্রামের মুসলমান প্রতিবেশীদের কাছেই আশ্রয় পেয়েছিল। যে দেশে জমি নিয়ে প্রতিবেশী প্রতিবেশীকে খুন করে, মামলা দেয়, সেই দেশে প্রতিবেশী মুসলমানকে দিয়ে প্রতিবেশী হিন্দুর বাড়িতে হামলা করানো এখনো কঠিন। এটা একটা লক্ষণ, যা বলে বিষয়টি যতটা না সাম্প্রদায়িক, তার চেয়ে বেশি অন্য কিছু।
ভারতীয় সমাজ-মনস্তত্ত্বের গবেষক আশীষ নন্দী দাঙ্গা নিয়ে গবেষণার জন্য দুনিয়ায় ভালোই বিখ্যাত। বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং তার পরের দাঙ্গা নিয়ে গবেষণা করে বইও প্রকাশ করেছেন। নন্দীর প্রথম কথা হচ্ছে, দাঙ্গা শহুরে ব্যাপার (ফেসবুক আসার পর গ্রাম ও শহরের আর পার্থক্য থাকছে না। গুজব-ছবি-উসকানি খুব দ্রুত ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়, তাই ফেসবুকে থাকা মানেই শহুরে যোগাযোগ জালের মধ্যে ঢুকে পড়া)। দ্বিতীয়ত, দাঙ্গা সব সময়ই রাজনৈতিক কর্মীদের দ্বারা সংঘটিত করা হয়, স্বতঃস্ফূর্ত দাঙ্গা বলে কিছু নেই। দাঙ্গার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকবেই। সব দাঙ্গাই ২ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে থামানো যায়। না থামলে ধরে নিতে হবে, ক্ষমতাসীনেরা এর পেছনে—ঠিক যেমনটা ঘটেছিল অযোধ্যায় ও গুজরাটে।
সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সংস্কৃতি বাংলাদেশে আলবৎ দানা বাঁধছে, কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো অন্য কিছু। এই ‘কিছু’টা কী, কেন তা ঘটানো হচ্ছে বা ঘটতে দেওয়া হচ্ছে, তার উত্তর আমাদের পেতে হবে।
রামুর ঘটনার পর এই লেখকের কলামে বলা কথাগুলো আবারও বলা দরকার: ‘দেশের সব মানুষ সাম্প্রদায়িক ঘৃণায় অন্ধ হয়ে যেতে পারে না। তা হলেও ইসলাম অবমাননার সাজানো ঘটনার ধুলায় সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকে ধোঁকায় ফেলা গেছে। গুজব আর উসকানির ধোঁয়া সরিয়ে বুঝতে সময় লেগেছে মানুষের। তখনই জানা যাচ্ছে, দেশের আত্মা মার খেয়েছে, তবে মরে যায়নি। রামু ও উখিয়ার সাধারণ মানুষের ওই প্রতিরোধ দাবানলে পুড়ে যাওয়া শস্যক্ষেত্রের মাঝে একগুচ্ছ সবুজের আশ্বাস। তা হলেও অনেকেই আসেনি, অনেকেই ভয়ে বা দ্বিধায় জড় হয়ে গিয়েছিল, এটাও মিথ্যা নয়। সেই দ্বিধাবিভক্ত আমাদের কাঁধেই দায় বর্তেছে জানিয়ে দেওয়ার যে আমাদের নামে আর অনাচার নয়, দেশের গায়ে আর কলঙ্ক নয়।
‘বনের বাঘকে তাড়ানো সহজ, মনের বাঘই কুরে কুরে খায়। দেশভাগের পরও, অসাম্প্রদায়িক একাত্তরের পরও সাম্প্রদায়িক মনের বাঘ রক্ত খেয়েই চলেছে। অনিঃশেষ দেশভাগ হৃদয়েও ফাটল ধরাচ্ছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতিও তাদের অনুকূলে। মওকা বুঝে সমাজবহির্ভূত শক্তি সেই ফাটলকে খাদ বানাতে কসুর করছে না। এই ফাটল বোজানোর দায় সংখ্যাগরিষ্ঠের। কেবল হামলা-আক্রমণ-বিদ্বেষ থেকে বিরত থাকলেই হবে না, প্রতিবেশী ও সহনাগরিকদের জানিয়ে দিতে হবে: এই অনাচার আমাদের নামে হতে দেওয়া যাবে না, আমাদের দেশের বুকে হতে দেওয়া যাবে না। কথায় ও কাজে, ইমান ও আমলে প্রমাণ করতে হবে, নাম-পরিচয়, সমাজ-সম্প্রদায় আলাদা হতে পারে, কিন্তু আমরা এক দেশের সহবাসী এক রাষ্ট্রের সহনাগরিক। যারা বাংলাদেশকে ভেতর-বাইরে ডোবাতে চায়, আমাদের নাম-পরিচয়কে আমরা তাদের কাজে ব্যবহৃত হতে দিতে পারি না।’