১০ নভেম্বর একটি বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এটা ১৯৮৩ সালের কথা। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতির পদটি দখল করে সবার ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। সংবিধান মেনে যঁারা রাজনীতি করেন বা মুখে হলেও উচ্চারণ করেন, তঁারা চাইছিলেন একটি নির্বাচিত সরকার। এরশাদ রাজনীতির রসায়নটি বুঝতে বেশি সময় নেননি। সে জন্য তঁার শাসন জারি ছিল লম্বা সময় ধরে।
তত দিনে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাতিল হয়ে যাওয়া জামায়াতে ইসলামী নতুন করে নিজেদের সংগঠিত করে তুলেছে। এরশাদের বিরুদ্ধে রাজপথের রাজনীতিতে প্রায় সব দলই সরব। ঠিক এই সময় জামায়াত নতুন এক রাজনৈতিক দাবি নিয়ে মাঠে হাজির হলো। ১৯৮৪ সালের ১০ এপ্রিল জামায়ত ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের এবং তাদের নেতা গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই ধারণা পরে অন্য সব দল লুফে নেয়। এরশাদ জানতেন, বিরোধীরা সবাই যদি এককাট্টা হয়, তাহলে তঁার দিন ফুরোবে।
ইতিমধ্যে এরশাদ তঁার নিজস্ব রাজনৈতিক দল বানানোর আয়োজন প্রায় শেষ করে এনেছেন। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি নিজেকে চেয়ারম্যান করে তিনি ‘জাতীয় পার্টি’ তৈরি করলেন। ওই বছরের মার্চে তিনি ঘোষণা দিলেন, ৭ মে নির্বাচন হবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫-দলীয় জোট এবং বিএনপির নেতৃত্বে ৭-দলীয় জোট ১৭ মার্চ ১৯৮৬ এক যৌথ সভায় নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। ১৯ মার্চ চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে এক জনসভায় ১৫-দলীয় জোটের নেতা শেখ হাসিনা ‘স্বৈরাচারের নির্বাচনে’ অংশগ্রহণকারীদের ‘জাতীয় বেইমান’ হিসেবে চিহ্নিত করার ঘোষণা দেন। কয়েক দিন পর অদৃশ্য কারণে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ১৫-দলীয় জোটের সঙ্গে ৭-দলীয় জোটের সমঝোতা ভেঙে যায়। বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। নির্বাচনী দৌড়ে আওয়ামী লীগের সহযাত্রী হয় জামায়াতে ইসলামী, সিপিবি, ন্যাপ (মোজাফফর) এবং আরও কয়েকটি ছোট দল। আওয়ামী লীগের মতো একটি পুরোনো ও বড় দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় এরশাদের শাসন শুধু টিকে যায়নি, রাজনৈতিক বৈধতাও পেয়ে যায়। সবাই নির্বাচন বর্জন করলে দৃশ্যপট পাল্টে যেত।
৭ মে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরশাদ রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা বহাল রেখে নিজেই এক সাজানো নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি হন। আওয়ামী লীগের মোহভঙ্গ হয়। ১৯৮৭ সালের ২৮ অক্টোবর ১৫ দল ও ৭ দলের নেতাদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় শেখ হাসিনার স্বামী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার মহাখালীস্থ আণবিক শক্তি কমিশনের আবাসিক কলোনির ফ্ল্যাটে। তঁারা একটি যৌথ ইশতেহার তৈরি করেন। দুই জোটের মতিগতি দেখে এরশাদ প্রমাদ গোনেন। তিনি জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন।
১৫ দল ও ৭ দল তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আবার মুখর হয়। এই দাবিতে ‘যুগপৎ’ আন্দোলনে নামে জামায়াতে ইসলামীও। ১১ ও ১২ নভেম্বর ১৯৮৭ সালে হরতাল ডাকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। ঢাকায় জারি হয় ১৪৪ ধারা। বাধানিষেধ উপেক্ষা করে ১০ নভেম্বর জনতার ঢল নামে রাজপথে। পল্টনের মোড় জিরো পয়েন্টের কাছে পুলিশের গুলিতে অনেকেই হতাহত হন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন নুরুল হুদা বুলবুল, আমিনুল হুদা ও নূর হোসেন। নুরুল ও আমিনুলের কথা মানুষ মনে রাখেনি। নূর হোসেন এখনো অনেকের স্মৃতিতে রয়েছে। কারণ, তঁার শরীর হয়ে উঠেছিল কাব্যময়। সে আরেক ইতিহাস।
পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার ঝাটিবুনিয়া গ্রামে নূর হোসেনের জন্ম। মুক্তিযুদ্ধের পর তঁাদের পরিবার ঢাকায় চলে আসে এবং বনগ্রামে থিতু হয়। তঁার বাবা ছিলেন গাড়িচালক। দারিদ্র্য নূরকে বেশি দূর এগোতে দেয়নি। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি স্কুল থেকে ঝরে পড়েন। বাবার মতো গাড়ি চালনার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। দিন এনে দিন খাওয়া পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি ঝুঁকে পড়েছিলেন রাজনীতিতে। বনগ্রাম যুবলীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। একটি দরিদ্র পরিবারের ২৬ বছর বয়সী এই তরুণ কেমন করে রাজপথের নায়ক হয়ে উঠেছিলেন, সেই কাহিনি গল্পের চেয়েও রোমাঞ্চকর।
নূর হোসেনের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ইকরাম হোসেন। ১৯ বছরের এই তরুণ ঢাকার রাজধানী সুপার মার্কেটের কাছে ‘আর্ট হ্যাভেন’ নামের একটি ছোট দোকানের মালিক। নূর হোসেনের সঙ্গে তঁার চেনাজানা ছিল। ডেটলাইন ৮ নভেম্বর ১৯৮৭। নিজের দোকানে বসে কাজ করছিলেন ইকরাম। সকালবেলা কয়েকজন সঙ্গীসহ সেখানে হাজির হন নূর হোসেন। একটি কাজ করে দেওয়ার অনুরোধ জানান। ইকরাম তখন বেশ ব্যস্ত। নূরকে পরদিন আসতে বললেন। নূর যথারীতি এলেন ৯ নভেম্বর বিকেলে। তিনি ইকরামকে নিয়ে গেলেন ক্যাফে চায়নার গলির পাশে। খুলে ফেললেন গায়ের জামা। বললেন, আজ আপনি এমন কিছু কথা লিখবেন, যা আগে কখনো লেখেননি। নূর জানালেন, লিখতে হবে তঁার শরীরে। পাশের দেয়ালে তিনি চক দিয়ে লিখলেন, ‘স্বৈরাচার নীপাত যাক, গনতন্ত্র মুক্তি পাক’—ঠিক এই বানানে। সাদা অ্যানামেল রঙের কৌটার মুখ খুলে ইকরাম তুলির আঁচড়ে নূরের বুক আর পিঠে বিশ মিনিটের মধ্যে লিখলেন সময়ের শ্রেষ্ঠ এই কবিতা (সূত্র: সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, দীপংকর চন্দ, প্রথম আলো, ১০ নভেম্বর ২০০৯)। পরদিন ১৪৪ ধারাকে তর্জনী দেখিয়ে জনতার ঢলে মিশে গেলেন নূর। একটি তপ্ত সিসা তঁার শরীরের ভেতর ঢুকে গেল। এই কবিতা ধারণ করেই নূর হোসেন রাজপথ রক্তে রাঙিয়ে দিলেন আর ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠলেন।
এ দেশে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম নিত্যদিনের বিষয়। এখানে প্রতিনিয়ত স্লোগান তৈরি হয়। অনেক স্লোগান বেশ চঁাছাছোলা, নিরেট গদ্য। তবে কাব্যিক ব্যঞ্জনা থাকে অনেক স্লোগানে। সেগুলো টিকে যায়, কালোত্তীর্ণ হয়। যেমন ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’। কিংবা ‘রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়’। এসব স্লোগান প্রথম কে কবে দিয়েছিলেন, তা জানা যায় না। আমাদের দেশের রাজনীতির অঙ্গনে স্বতঃস্ফূর্ততা একটি অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে বারবার। তবে নূর হোসেন বুকে-পিঠে যে স্লোগান ধারণ করেছিলেন, তার কাব্যময়তা অসাধারণ সুন্দর। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গূঢ় রাজনৈতিক দর্শন।
১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ জেনারেল এরশাদ আরেকটি সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করলেন। এটা ছিল অনেকটাই লোকদেখানো। মূলধারার কোনো রাজনৈতিক দল এতে অংশ নেয়নি। এরশাদের জাতীয় পার্টির সহযাত্রী হয়েছিল আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাসদের একটি অংশ, শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন জাসদের অন্য একটি অংশ, ফারুক-রশিদের নেতৃত্বে ফ্রিডম পার্টি এবং আরও কয়েকটি নাম-গোত্রহীন দল। এই নির্বাচন রাজনৈতিক বৈধতা পায়নি এবং প্রধান দলগুলো নির্বাচন বর্জন করায় এরশাদ সরকারের মৃত্যুঘণ্টা বেজে যায়। নূর হোসেনদের রক্ত মাড়িয়ে যারা এই নির্বাচনে শরিক হয়েছিল, তাদের সংসদের আয়ু ছিল ক্ষণস্থায়ী। এরশাদ সরকারের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর তখনকার চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল নূরউদ্দিন এবং চিফ অব জেনারের স্টাফ মে. জেনারেল আবদুস সালাম। তঁারা সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় এরশাদকে পদত্যাগ করতে হলো। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হলো অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আর এই দাবিতেই তো প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন নূর হোসেনের মতো জানা-অজানা অনেক তরুণ।
সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করল। বেগম খালেদা জিয়া হলেন প্রধানমন্ত্রী। ওই বছরই প্রয়াত নূর হোসেনের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে সরকার একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। যে ‘জিরো পয়েন্টের’ কাছে নূর নিহত হয়েছিলেন, তার নতুন নামকরণ হয় ‘শহীদ নূর হোসেন স্কয়ার’। বেঁচে থাকলে হয়তো নূর হোসেন আরও হাজারো অসচ্ছল পরিবারের তরুণের মতো ধুঁকে ধুঁকে মরতেন। মরে গিয়ে তিনি অমর হলেন। কিন্তু প্রশ্ন একটা থেকেই গেল। স্বৈরাচারের কি নিপাত হলো? গণতন্ত্র কি মুক্তি পেল?
১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে পরপর দুবার এরশাদ পঁাচটি আসনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯১-৯৬ পর্বে তিনি সংসদে বসতে পারেননি। পুরো সময়টা কাটিয়েছেন জেলখানায়। তঁার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা ছিল। একটিতে তঁার সাজা হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ম্যাজিকের মতো একটার পর একটা মামলায় এরশাদ জামিন পেতে থাকেন। একসময় প্রবল পরাক্রমে উপস্থিত হন জাতীয় সংসদে। সেখানে দঁাড়িয়ে তিনি নূর হোসেনের জন্য ক্ষমা চেয়ে একটি প্রকাশ্য ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে তিনি ‘লাশ নিয়ে রাজনীতি’র সমালোচনা করেন। এরশাদের ক্ষমা চাওয়ার ঘোষণা কবরে শুয়ে নূর হোসেন শুনেছিলেন কি না, জানি না। মৃতরা জীবিতদের কথা কি শুনতে পান? পেলে হয়তো তিনি অট্টহাসি দিয়ে উঠতেন। আমার জানামতে, এরশাদই এই মহাদেশের একমাত্র জেনারেল, যিনি গণ-আন্দোলনে ক্ষমতা হারিয়ে আবারও নিজেকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করতে পেরেছেন। এটা কি তঁার সক্ষমতা কিংবা শক্তিমত্তার পরিচায়ক, নাকি এটা এ দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অসারতা? নূর হোসেনের প্রয়াণবার্ষিকীতে এই প্রশ্ন ফিরে আসবে বারবার।
২০১০ সালের ২৩ নভেম্বর ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকে এক সাক্ষাৎকারে নূর হোসেনের মা মরিয়ম বিবি বলেছিলেন, দেশে এখনো গণতন্ত্র আসেনি। তঁার এই কথাটি আমাদের ভাবায়।