১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ই থেমে গিয়েছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলব্যবস্থা। ৪৩ বছর পর সেই ২০০৮ সালে ঢাকা ও কলকাতার মধ্যে চালু হয় যাত্রীবাহী ট্রেন মৈত্রী এক্সপ্রেস।
তবে ট্রেন চালু হলেও ভোগান্তি কিছুটা ছিলই। নিরাপত্তার স্বার্থে যাত্রাপথে দুই দেশের দুই প্রান্তের স্টেশনে ট্রেন থামত। সেখানেই যাত্রীদের নেমে আলাদা কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হতো। এভাবে প্রায় সাড়ে ৯ বছর চলার পর সেই ভোগান্তি দূর হয়ে যাচ্ছে আজ শুক্রবার থেকে। এখন যাত্রীদের ঢাকা ও কলকাতায় ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে। অর্থাৎ ঢাকায় ওঠার পর এবং কলকাতায় নামার পর আনুষ্ঠানিকতা পর্ব সারতে হবে। এতে ঢাকা ও কলকাতার মধ্যে মৈত্রী এক্সপ্রেসের যাত্রা সময় কমে ছয় ঘণ্টায় নেমে আসবে।
ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গতকাল বৃহস্পতিবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নতুন এ ব্যবস্থার উদ্বোধন ঘোষণা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কলকাতা থেকে তাঁদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দেন।
একই সঙ্গে দুই দেশের শীর্ষ নেতারা গতকাল কলকাতা ও খুলনার মধ্যে নতুন যাত্রীবাহী ট্রেন ‘বন্ধন এক্সপ্রেসের’ চলাচল উদ্বোধন করেন। এ দুই শহরের মধ্যে রেল যোগাযোগ বন্ধ ছিল ৫২ বছর।
এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি গতকাল একই অনুষ্ঠানে কলকাতার চিতপুরে রেলওয়ে টার্মিনাল, ভারতীয় ১০ কোটি ডলার ঋণে এ দেশে নির্মিত দ্বিতীয় ভৈরব ও দ্বিতীয় তিতাস সেতু উদ্বোধন করেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে কানেক্টিভিটি প্রকল্প উদ্বোধন অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদি দুই দেশের জনগণকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বাংলায় বলেন, ‘আজ আমাদের মৈত্রীর বন্ধন আরো সুদৃঢ় হলো। ’
দুই দেশের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, যোগাযোগব্যবস্থা আরো সহজ করার এই দৃষ্টান্ত পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্কের প্রতিফলন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভারতীয় কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, দুই দেশের মধ্যে ট্রেন চলাচল চালুর প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই তিনি যুক্ত ছিলেন। আজ দুই দেশ থেকেই যাত্রা শুরু ও শেষে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে। অথচ কয়েক বছর আগেও এমনটি ভাবাই যেত না। এখন দুই দেশের সম্পর্কে যে আস্থা বিরাজ করছে তা অব্যাহত থাকলে আগামীতে উভয় দেশের জনগণ আরো অনেক সুফল পাবে।
বন্ধন এক্সপ্রেস আগামী ১৬ নভেম্বর থেকে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রা শুরু করবে। প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টায় ট্রেনটি কলকাতা থেকে ছাড়বে। খুলনায় পৌঁছাবে দুপুর ১টায়। একই দিন ট্রেনটি দুপুর দেড়টায় খুলনা থেকে কলকাতার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে।
ভিডিও কনফারেন্সে নরেন্দ্র মোদি ব্যক্তিগতভাবে ও ভারতের জনগণের পক্ষে শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য কামনা করেন। তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর নেতাদের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিবেশীদের মতোই হওয়া উচিত। যখনই মনে হবে তখন তাঁরা কথা বলবেন, দেখা করবেন। এগুলো প্রটোকলের বাধায় আটকে থাকা উচিত নয়।
মোদি বলেন, কিছু দিন আগে দক্ষিণ এশীয় স্যাটেলাইট উেক্ষপণ উপলক্ষে তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেছেন। গত বছর পেট্রাপোলে সমন্বিত চেকপোস্ট (আইসিপি) উদ্বোধনের সময়ও তাঁরা ভিডিও কনফারেন্স করেছেন। আর এবার শেখ হাসিনার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সংযোগ জোরদারকারী প্রকল্প উদ্বোধন করতে পেরে তিনি আনন্দিত।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মানুষে মানুষে যোগাযোগ। ‘মৈত্রী’ ও ‘বন্ধন’—দুটি ট্রেন সেবা দুই দেশের অভিন্ন লক্ষ্য থেকেই এসেছে।
মোদি বলেন, ১৯৬৫ সালের আগে যে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল দুই দেশের মধ্যে এখন সেই সংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উভয় দেশ কাজ করছে। ভারতীয় ঋণে নির্মিত দ্বিতীয় ভৈরব ও দ্বিতীয় তিতাস সেতু বাংলাদেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকেও শক্তিশালী করবে। বাংলাদেশের উন্নয়নে বিশ্বস্ত অংশীদার হওয়া ভারতের জন্য গর্বের বিষয়। সহজ শর্তে ভারতীয় ৮০০ কোটি ডলার অর্থায়নের আওতায় প্রকল্পগুলোর ভালো অগ্রগতি হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের সম্পর্ক জোরদার ও শক্তিশালী করার মাধ্যমে উন্নতি ও সমৃদ্ধির নতুন আকাশ ছোঁব—এ ব্যাপারে আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস আছে। ’ তিনি তাঁর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুকে সম্মান এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের শুভকামনা জানান।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়াকে শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাওয়ার লক্ষ্যে তিনি ভারতসহ অন্য নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে চান। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়াকে একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা ভারত ও অন্যান্য নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গে সহযোগিতা করতে চাই, যাতে আমরা সুপ্রতিবেশী হিসেবে পাশাপাশি বাস করতে এবং জনগণের কল্যাণ করতে পারি। ’
দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান চমৎকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এই সম্পর্ক বজায় থাকা উভয় দেশের উন্নয়নের জন্য জরুরি বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক এ অঞ্চলে এবং অঞ্চল ছাড়িয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় পৌঁছানোর নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ’
নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে আমাদের দুই দেশের জনগণের কল্যাণে আগামীতে এ ধরনের আরো অনেক আনন্দঘন মুহূর্ত অপেক্ষা করছে। আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে আমি সব সময় আপনাদের সঙ্গে কাজ করার অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকব। আমাদের এই বন্ধন শুধু রেল যোগাযোগে নয়, এর মাধ্যমে যাতে দুই দেশের জনগণের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি করে দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, সেটিই আমাদের কাম্য। ’
প্রধানমন্ত্রী মৈত্রী এক্সপ্রেস ও বন্ধন এক্সপ্রেসের সার্বিক সাফল্য কামনা করে বলেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়, পর্যটন উন্নয়ন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সব কিছুই আরো উন্নত হবে। আজকে যে একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো সে জন্য আমাদের সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হবে। ’
দুই দেশের বিদ্যমান সম্পর্ক অত্যন্ত চমৎকার থাকার কথা পুনরুল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই সম্পর্ক কেবল রেল, নদী বা আকাশপথে সংযুক্তিই নয়, আমরা এখন ইন্টারনেট, উপকূলীয় নৌপথ, বিদ্যুৎ গ্রিড ইত্যাদির মাধ্যমেও আমরা সংযুক্ত। আমাদের এই সংযুক্ত হওয়ার নতুন নতুন পথ সার্বিক যোগাযোগের কাঠামোতে বিচিত্র মাত্রা যোগ করেছে। সম্প্রতি আমাদের এই যোগাযোগ মহাকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে আঞ্চলিক সহযোগিতার যে রূপকল্প দিয়েছিলেন, তা সব সময়ই আমাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আজকের এসব উদ্যোগের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন পূরণ আরো সফল হবে। ’
বাসস জানায়, নয়াদিল্লিতে মোদির সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এবং গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, সংসদ সদস্য ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর, দ্বিতীয় ভৈরব সেতু এলাকা থেকে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী, বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিমও এ সময় গণভবনে উপস্থিত ছিলেন।
দ্বিতীয় ভৈরব সেতুর নামকরণ জিল্লুর রহমানের নামে : ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ভৈরব (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট রেলপথে দ্বিতীয় ভৈরব সেতু প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের নামে নামকরণের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. সায়দুল্লাহ মিয়ার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী তাত্ক্ষণিকভাবে এ ঘোষণা দেন।
দ্বিতীয় ভৈরব ও দ্বিতীয় তিতাস সেতুর উদ্বোধন ঘোষণার পরপরই একটি ডেমু কমিউটার ট্রেন দ্বিতীয় ভৈরব সেতু অতিক্রম করে।
বন্ধন এক্সপ্রেস চলবে ১৬ নভেম্বর থেকে : নিজস্ব প্রতিবেদক, কলকাতা জানান, কলকাতার চিতপুর স্টেশন থেকে স্থানীয় সময় সকাল সোয়া ১১টায় (বাংলাদেশ সময় দুপুর পৌনে ১২টা) খুলনার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে কলকাতা-খুলনা রুটের আন্তর্জাতিক ট্রেন বন্ধন এক্সপ্রেস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবুজ পতাকা দেখিয়ে ওই ট্রেন যাত্রা উদ্বোধন করেন।
৪৫৪ আসনের ওই ট্রেনে গতকাল কোনো সাধারণ যাত্রী ছিলেন না। খুলনা থেকে কলকাতায় আসা বাংলাদেশের রেল মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন প্রতিনিধি এবং ভারতীয় রেলের কয়েকজন সদস্য ছিলেন এর যাত্রী।
বেনাপোল (যশোর) প্রতিনিধি জানান, বন্ধন এক্সপ্রেস বেনাপোলে পৌঁছে গতকাল দুপুর দেড়টায়। ট্রেনের কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন কার্যাদি আপাতত বেনাপোল রেলস্টেশনে সম্পন্ন হয়েছে। যাত্রীদের ব্যাগেজ স্ক্যানিং কাজও এখানে সম্পন্ন করা হয়। সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন শেষে দুপুর আড়াইটায় বেনাপোল থেকে খুলনার উদ্দেশে ছেড়ে যায় ট্রেনটি।