প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এস কে সিনহা) ছুটি শেষ হচ্ছে আগামীকাল ১০ নভেম্বর শুক্রবার। একই তারিখে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার দায়িত্বকালও শেষ হচ্ছে। এ অবস্থায় ছুটির মেয়াদ শেষে বিদেশে অবস্থানরত প্রধান বিচারপতি দেশে ফিরে আবার প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারবেন এবং বিচার করতে পারবেন বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জয়নুল আবেদীন। অপর দিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ছুটি শেষ হওয়ার পর কী হবে তা নির্ভর করছে প্রধান বিচারপতি কী করেন তার ওপর। তবে প্রধান বিচারপতি দেশে এসে দায়িত্বে ফেরা সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি বারবার বলছি এবং এখনো বলছি, প্রধান বিচারপতির দেশে ফিরে দায়িত্ব নেয়া সুদূরপরাহত।
দেশে ফিরে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ সম্পর্কে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দেশে ফিরে দায়িত্বগ্রহণ সুদূরপরাহত। প্রধান বিচারপতির ছুটি শেষ হচ্ছে ১০ নভেম্বর। একই সাথে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকেও একই সময় পর্যন্ত কার্যভার পালনের জন্য রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব দিয়েছেন, এই অবস্থায় পরবর্তী প্রক্রিয়া কি হবে? এ প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা নির্ভর করছে উনি (প্রধান বিচারপতি) কী করেন।
প্রধান বিচারপতি কি দেশে ফিরে আবার তার দায়িত্বে ফিরতে পারবেনÑ এ প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা কিভাবে সম্ভব। তার সহকর্মীরাই তো তার সাথে বসতে চান না। অ্যাটর্নি জেনারেলের এই বক্তব্য প্রসঙ্গে তাকে উদ্দেশ করে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেছেন, এটা আপনার ও সরকারের বক্তব্য? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, জজদের দেয়া প্রেস নোটে এটা রয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা তার পক্ষ নিয়ে এসব কথা বলছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করলে কী ব্যবস্থা তা সংবিধানে বলা আছে। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা পদত্যাগ করলেও কোনো সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে না। প্রধান বিচারপতি ছুটি বাড়ান আর পদত্যাগ করুন সংবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন রাষ্ট্রপতি।
অ্যাটর্নি জেনারেল আরো বলেন, আমি বারবার বলছি এবং এখনো বলছি প্রধান বিচারপতির দেশে ফিরে দায়িত্ব নেয়া সুদূরপরাহত। কারণ তার সহকর্মী বিচারপতিরাই তার সাথে বসতে চান না।
অন্য দিকে প্রধান বিচারপতি দেশে ফিরে দায়িত্ব নেয়া সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক প্রধান বিচারপতি শপথ নিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রধান বিচারপতি সুস্থ থাকা সত্ত্বেও সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাকে অসুস্থ বলে জোর করে ছুটিতে পাঠিয়েছে। এর পেছনে কারণ তিনি ষোড়শ সংশোধনীর রায় দিয়েছেন। এ রায় না দিলে তাকে অসুস্থ হতে হতো না এবং বিদেশে যেতে হতো না। তিনি বিদেশে যাওয়ার আগে খোলা চিঠিতে বলেছেন, আমি অসুস্থ নই, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। আমি চলে যাচ্ছি, পালিয়ে যাচ্ছি না। আমি আবার দেশে ফিরে আসব। আমরা মনে করি তিনি যেখানে থাকুন পদত্যাগ বা অবসরে না যাওয়া পর্যন্ত তিনিই বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। তিনি দেশে ফিরে প্রধান বিচারপতি হিসেবে যোগদান করবেন এবং বিচার করতে পারবেন।
জয়নুল আবেদীন বলেন, অতীতে কখনো বিচারপতিদের ঘনঘন বঙ্গভবনে ডালভাতের দাওয়াতে যেতে দেখা যায়নি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একবার বিচারপতিদের ডাকা হয়েছিল বিদায় করার জন্য। তিনি বলেন, ইদানীং বিচারাঙ্গনে আইনমন্ত্রীর বারবার পদচারণা দেখা যায়। এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য শুভ লক্ষণ নয়।
জয়নুল আবেদীন অরো বলেন, শোনা যায়, প্রধান বিচারপতির বিষয় নিয়ে সিঙ্গাপুরে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। কেউ কেউ সমাধানের জন্য ভারতে গিয়েছেন। তাহলে দেশে কি সমাধান নেই? সংবিধানেই এর সমাধান রয়েছে। তিনি বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল ও সরকার ছাড়া আপিল বিভাগের কোনো বিচারপতি বলেননি আমরা প্রধান বিচারপতির সাথে বসব না। যদি বিচারপতিরা বসতে না চান তা হলে বলবÑ এটা শপথ ভঙ্গ ও সংবিধান লঙ্ঘন।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, রাষ্ট্রপতি কি প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতিকে ডাকতে পারেন। সবাই আইনের মধ্যে রাষ্ট্রপতিও আইনের মধ্যে। তিনিও যা তা করতে পারেন না। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি সমগ্র বিচার বিভাগে ক্যান্সার সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, এক মাস পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগ আনেননি। রাজনৈতিকভাবে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি বলেন, আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বলব, প্রেস নোটে যা বলেছেন তা কি বলা উচিত হয়েছে।
ব্যারিস্টার খোকন বলেন, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, তিনি অসুস্থ নন। সরকার ক্যান্সারের কথা বলে বিচার বিভাগে ক্যান্সার ছড়িয়ে দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ধমক দিচ্ছেন, প্রধান বিচারপতি এলে তার বসা সুদূরপরাহত। উনার এই থ্রেট (ধমক) দেয়ার অধিকার নেই। এই থ্রেট দেয়ার জন্য উনার সিদ্ধান্ত উনার নেয়া উচিত।
গত ১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এক মাসের ছুটির কথা জানিয়ে চিঠি দেন। এখন তার ছুটি ১০ নভেম্বর পর্যন্ত। গত ১৪ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।
অবকাশকালীন ছুটি শেষে গত ২ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট খোলার আগের দিন অসুস্থতার কথা জানিয়ে এক মাসের (৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর) ছুটিতে যান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। পরে বিদেশে যেতে আরো ১০ দিনের (২ থেকে ১০ নভেম্বর) ছুটি বাড়িয়ে নেন তিনি।
গত ২ অক্টোবর আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো: আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে ওই এক মাসের জন্য প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনের দায়িত্ব দেন রাষ্ট্রপতি। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ছুটি বেড়ে যাওয়ায় বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার দায়িত্বকালও ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বাড়ান রাষ্ট্রপতি।
এ দিকে বিদেশে যাওয়ার প্রাক্কালে বাসভবনের গেটে সাংবাদিকদের লিখিত বক্তব্য দিয়ে যান প্রধান বিচারপতি। পরদিন বিবৃতি দিয়ে প্রধান বিচারপতির ওই বক্তব্যকে বিভ্রান্তিমূলক উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্ট বলেন, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সংবলিত দালিলিক তথ্যাদি আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির কাছে হস্তান্তর করেছেন। এর মধ্যে বিদেশে অর্থপাচার, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, নৈতিক স্খলনসহ আরো সুনির্দিষ্ট গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।