মডেল ও অভিনয়শিল্পী জান্নাতুল পিয়া ছোটবেলা থেকেই স্বাধীনচেতা। নিজের মতো করে চলতে পছন্দ করেন। খুলনায় যৌথ পরিবারে বড় হয়েছেন—একই বাড়িতে সবাই মিলে থাকতেন। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে একেকজনের মত ছিল একেক রকম। কিন্তু একটি জায়গায় সবার মত এক জায়গায় এসে ঠেকেছিল। মডেলিংকে পিয়া ক্যারিয়ার হিসেবে নিক, সেটা পরিবারের কেউ চাননি। পাশে ছিলেন শুধু মা। পিয়া বুঝতে পারেন, এখানে থাকলে স্বপ্নের পথে তাঁর হাঁটা হবে না। লক্ষ্যে পৌঁছাতে পিয়া এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। আজ পিয়ার সাফল্যের মুকুটে যুক্ত হয়েছে অনেক পালক। পিয়াকে এ অবস্থানে আসার জন্য সবচেয়ে বেশি লড়াই করতে হয়েছে পরিবার আর সমাজের সঙ্গে। নিজের সাহসিকতা ও পরিশ্রম দিয়ে নিজের লক্ষ্যে ঠিকই পৌঁছেছেন।
‘যখন ঢাকায় আসি, তখন আমার এসএসসির রেজাল্টও দেয়নি। খুলনা থেকে আম্মা টাকা পাঠাতেন। নিজের হাত খরচের জন্য তখন খণ্ডকালীন কাজ করেছি। প্রথম দিকে মডেলিং করে তো তেমন টাকা পেতাম না। এ জন্য বাড়তি অনেক কাজ করে আমাকে আয় করতে হতো। আজকের এ অবস্থানে আসার জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে।’ বললেন পিয়া।
ঢাকায় র্যাম্প মডেলিং করতে এসে পিয়া বৈষম্যের শিকার হন। খুলনা থেকে একটি মেয়ে এসে সবার মনোযোগ পেয়ে যাবেন, এটা ঢাকার কয়েকজন মডেল একেবারেই মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা শুধু পিয়ার দোষ খুঁজে বেড়াতেন। পিয়ার ‘দোষ’ ছিল তিনি লম্বা! তিনি জানেন না কখন কী বলতে হবে, কী করতে হবে—আরও অনেক কিছু। সদ্য স্কুলের গণ্ডি পেরোনো এক কিশোরী তখন এসবের কিছুই বোঝেনি। ক্যাম্পে লম্বা মেয়েদেরই কদর বেশি, এটা তিনি শুনেছিলেন, কিন্তু কাজ করতে আসার পর অনেকে কেন তাঁর পিছে লেগেছেন, সেটা বুঝতে পারেন আরও কিছুদিন পর।
পিয়া বলেন, ‘আমার একটা বড় গুণ হলো, আমি পরিস্থিতির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারি। ঢাকায় আসার পর আমি পরিবেশের সঙ্গে অল্প সময়ের মধ্যে মানিয়ে নিয়েছিলাম। যোগ্যতা প্রমাণ করে এখানে নিজের একটা জায়গা করে নিতে পেরেছিলাম।’
রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হয়ে কোনো সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নাম লেখানো ছিল পিয়ার জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং। মডেলিং শুরুর পর পিয়ার বাবা তো রাগ করে তাঁর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বাবার এই অভিমান পর্ব চলেছে টানা তিন বছর। ২০০৭ সালে ‘মিস বাংলাদেশ’-এর মুকুট পাওয়ার পরও কিছু মানুষের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। অনেক প্রভাবশালীর মেয়েরা ছিলেন সেই প্রতিযোগিতায়। কিন্তু সবাইকে টপকে যোগ্যতার বলে পিয়া সেরা হন। মুকুট জিতে মঞ্চ থেকে নামার সময় তাঁকে মারতে এসেছিলেন অন্য এক প্রতিযোগীর পরিবারের সদস্যরা। কম বয়সী পিয়া এ ঘটনার পর ভয় পেয়ে ক্যারিয়ার সেখানেই শেষ করে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। এরপর এই তারকা ২০১১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় আয়োজিত ‘ওয়ার্ল্ড মিস ইউনিভার্সিটি’ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। ২০১৩ সালে ‘ইন্ডিয়ান প্রিন্সেস ইন্টারন্যাশনাল’ হন। একই বছর মিসরে আয়োজিত ‘টপ মডেল অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এ ছিলেন শীর্ষ দশে। হয়েছেন বিখ্যাত ফ্যাশন ম্যাগাজিন ‘ভোগ ইন্ডিয়া’র প্রচ্ছদকন্যা। অনেক বাধাবিপত্তি আর প্রতিকূলতা ছাপিয়ে পিয়া শুধু সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। এখন অবশ্য পরিবারের সবাই পিয়াকে নিয়ে গর্ব করেন।
কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। আইন বিষয়ে স্নাতক করেছেন। সামনে আইন বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করার ইচ্ছা আছে। পিয়া মনে করেন, মানুষের সমালোচনায় কান না দিয়ে নিজের কাজটা মনোযোগ দিয়ে করে যাওয়া উচিত। জীবনে তিনি এই নীতি মেনে চলেছেন। পিয়ার ভাষ্য, ‘নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলে মানুষের কথায় কান দেওয়ার সময় কোথায়? আর আমি বিশ্বাস করি, কাজের মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ করেই নিন্দুকদের মুখ বন্ধ করা সম্ভব।’
এগিয়ে যাওয়ার এই সাহস পিয়া পেলেন কী করে? পিয়ার উত্তর, ‘আমার আম্মার কাছ থেকে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। আমার জন্মের পর তিনি মাস্টার্স পাস করেছেন। খুলনায় নিজের একটি স্কুল পরিচালনা করছেন এখন। আম্মা আমাকে সব সময় বলতেন, আমি যদি এত প্রতিকূল অবস্থায় থেকে এই জায়গায় আসতে পারি, তুমি এই যুগের মেয়ে হয়ে কেন তা পারবে না?’
মায়ের এই কথা পিয়ার মনে গেঁথে যায়। শুরু থেকে মা পাশে না থাকলে আজ সত্যিই জান্নাতুল পিয়া হয়ে ওঠা হতো না তাঁর।