পুঁজিবাজারে মোট ১৭টি করণীয় মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন আইডিএলসি ফিন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আরিফ খান। এর মধ্যে রয়েছে ১০টি ‘কী করবেন’ এবং ৭টি ‘কী করবেন না’। মোট পরামর্শের ৯টি বিনিয়োগকারীদের জন্য, বাকি ৮টি তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য।
ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে গতকাল বুধবার বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ (বিএপিএলসি) আয়োজিত ‘পুঁজিবাজারের বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করে আরিফ খান এসব পরামর্শ দেন।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন, সম্মানিত অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন। বিএপিএলসির সভাপতি মুহাম্মদ আজিজ খান এতে স্বাগত বক্তব্য দেন। সঞ্চালক ছিলেন বিএপিএলসির সদস্য এবং গ্রিন ডেল্টা ইনস্যুরেন্সের এমডি ফারজানা চৌধুরী।
বিএসইসির সাবেক কমিশনার আরিফ খানের প্রবন্ধে বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘কী করবেন’ অংশে সুনির্দিষ্ট বিনিয়োগ লক্ষ্য, ঝুঁকিকে বিবেচনায় রাখা, দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গী থাকা, খোঁজ-খবর নেওয়া এবং কয়েকটি জায়গায় বিনিয়োগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ‘কী করবেন না’ অংশে পরামর্শ ছিল গুজবে কান না দেওয়া, বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর (সিন্ডিকেট) তৈরি কৃত্রিম মতের সঙ্গে গা না ভাসানো, শেয়ার কিনে নির্দিষ্ট কোনো দিনে বিক্রির জন্য অপেক্ষা না করা এবং বেশি বেশি লেনদেন না করার।
কোম্পানিগুলোর জন্য ‘কী করবেন’ অংশে আরিফ খানের পরামর্শ হচ্ছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ, স্বচ্ছতা, সময়মতো লভ্যাংশ ঘোষণা, যৌক্তিক তথ্য প্রকাশ করা এবং বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) অনুষ্ঠান করা। ‘কী করবেন না’ অংশে অনাকর্ষণীয় লভ্যাংশ ঘোষণা না করা, সংবেদনশীল তথ্য লুকিয়ে না রাখা এবং খারাপ মানের প্রতিবেদন তৈরি না করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
কোম্পানির পর্ষদে স্বতন্ত্র পরিচালকদের অনেকে উদ্যোক্তাদেরই আত্মীয়স্বজন এবং তাঁরা উদ্যোক্তাদের পক্ষে ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকেন বলে মনে করেন আরিফ খান। তিনি বলেন, বিশ্বের বেশির ভাগ পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর সংখ্যা খুবই কম। শেয়ার ব্যবসায়ে যুক্ত থাকেন মূলত প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। ক্ষুদ্রদের জন্য ভালো জায়গা হতে পারে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দেশে করপোরেট কর বেশি বলে স্বীকার করেন এবং ভবিষ্যতে তা কমিয়ে আনবেন বলে আশ্বাস দেন। অর্থমন্ত্রী অবশ্য এ-ও বলেন, ‘এটাও ঠিক যে দেশের অনেক মানুষের এখনো নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তাদের জন্য টাকা দরকার।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশের পুঁজিবাজারে বর্তমানে ভালো সময় যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও ভালো সময় আসবে। বহির্বিশ্বের লোকেরা এ বাজারে আসবে।
বিএসইসির চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন চেয়ারম্যান হিসেবে সংস্থাটিতে যোগ দেওয়ার পর যেসব সংস্কার হয়েছে, বরাবরের মতোই সেগুলো তুলে ধরেন সেমিনারে। তিনি আশাবাদী যে আগামী বছরগুলোতে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার বিনিয়োগ গন্তব্যস্থল হবে বাংলাদেশ।
বিএপিএলসির সভাপতি মুহাম্মদ আজিজ খান বলেন, ‘দেশের পুঁজিবাজার তত গভীর নয়, তারল্য সংকটও আছে এই বাজারে। এখানকার বাজার মূলধন মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ২২ শতাংশ। অথচ ভারতের বাজার মূলধন জিডিপির ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে অনেক আগেই।’ দেশে করপোরেট হার বেশি এবং তা কমিয়ে আনার দাবি জানান আজিজ খান।
আলোচনা: প্রবন্ধের ওপর নির্ধারিত আলোচক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মো. আবদুল মজিদ করব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ সন্ধিক্ষণে রয়েছে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘যত পারি কর নিয়ে নিই, পরে যদি না দেয়’ এমন মনোভাব নিয়ে চলছে দেশ। ঘাটে ঘাটে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) দিতে হয়।
ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি আহমেদ রশীদ মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এবং যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয়ের (আরজেএসসি) কাজের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে।
পিডব্লিউসি বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা অংশীদার মামুন রশীদ বলেন, ‘আমাদের পুঁজিবাজারের জন্য অনেক অর্থের দরকার। আর এ জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত আইনকানুনের সংস্কার জরুরি। বিএসইসি ভালো করছে, কিন্তু দুশ্চিন্তা (টেনশন) এখনো আছে।’
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বাজারে তালিকাভুক্তির ফাইল বহু বছর ধরে টেবিলে টেবিলে ঘুরছে উল্লেখ করে মামুন রশীদ বলেন, কাউকে জোর করে আনারও দরকার নেই। দেশীয় বড় ট্রেডিং কোম্পানিগুলো বাজারে এলে অন্যরাও আসবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
আলোচনায় আরও অংশ নেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি কে এ এম মাজেদুর রহমান এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের এমডি সাইফুর রহমান মজুমদার।