বগুড়ার শিবগঞ্জ ও রংপুরের তারাগঞ্জের কয়েকটি বিদ্যালয়ে জেএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করেও পরীক্ষায় বসেনি ১০০ ছাত্রী। বাল্যবিবাহ হয়ে যাওয়ায় তারা পরীক্ষা দিতে পারেনি বলে শিক্ষক, অভিভাবক ও সহপাঠীরা জানিয়েছেন। এদিকে কোনো শিশু ধর্ষণের শিকার হলে তার সঙ্গে যেন ধর্ষকের বিয়ে না হয়, তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ইনোভেশন ইউনিট
রংপুরের তারাগঞ্জের কুর্শা আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের চার ছাত্রীর বাড়িতে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার আগের দিন প্রবেশপত্র নিয়ে গিয়েছিলেন অফিস সহকারী যাদু মিয়া। তিনি বলেন, এই চারজনের কাউকেই বাড়িতে পাওয়া যায়নি। তারা এখন স্বামীর ঘরে।
বগুড়ার শিবগঞ্জের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী স্বপ্না খাতুন (ছদ্মনাম) সারা বছর লেখাপড়া করে ফরম পূরণ করলেও জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। পরীক্ষা শুরুর কয়েক দিন আগে তার বিয়ে হয়ে গেছে। পরীক্ষাকেন্দ্রের বদলে যেতে হয়েছে শ্বশুরবাড়ি।
এই পরিণতি শুধু স্বপ্নার নয়, বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে এ রকম ৮৩ ছাত্রীকে পাওয়া গেছে, যারা ফরম পূরণ করেছে অথচ পরীক্ষায় বসেনি। কয়েকটি স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবক ও সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অনুপস্থিত এই পরীক্ষার্থীদের বেশির ভাগই বাল্যবিবাহের শিকার। একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার আরও ১৭ ছাত্রীকে।
শিবগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্র জানায়, শিবগঞ্জ থেকে এবার জেএসসি পরীক্ষায় ৪ হাজার ৫১০ জন এবং জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষায় ১ হাজার ৪৫০ জন শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করে। ১ নভেম্বর থেকে পাঁচটি কেন্দ্রে জেএসসি ও দুটি কেন্দ্রে জেডিসি পরীক্ষা হচ্ছে।
এসব কেন্দ্রের তিনজন সচিব জানান, এবার জেএসসি পরীক্ষায় ৫৩ জন ছাত্রী পরীক্ষা দিতে আসেনি। এর মধ্যে শিবগঞ্জ পাইলট উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ১৪, বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ৭, মোকামতলা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ২২, গুজিয়া উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ৪ ও গুজিয়া গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ৬ জন ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। অন্যদিকে জেডিসি পরীক্ষায় ৩০ জন ছাত্রী পরীক্ষা দিতে আসেনি। তাদের মধ্যে শিবগঞ্জ মাদ্রাসাকেন্দ্রের ১৩ ও আলীয়ারহাট মাদ্রাসা কেন্দ্রের ১৭ জন ছাত্রী পরীক্ষা দিচ্ছে না।
কয়েকজন ছাত্রী, অভিভাবক এবং বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরীক্ষায় ছাত্রী অনুপস্থিতির প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ।
উপজেলার উথলী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাবিবুল আলম বলেন, তাঁর বিদ্যালয় থেকে এবার ১৬২ জন শিক্ষার্থী (৮৩ ছাত্র ও ৭৯ ছাত্রী) জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। কিন্তু ৩ জন ছাত্রী পরীক্ষায় অনুপস্থিত। তিনি বলেন, ‘আমি খোঁজ নিয়ে দেখলাম, এই তিন ছাত্রীই বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে।’
কালীতলা জুনিয়র বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুনজিলা বেগম বলেন, ‘আমার বিদ্যালয় থেকে ১০ জন ফরম পূরণ করে একজন পরীক্ষা দিচ্ছে না। সে বাল্যবিবাহের শিকার।’
শিবগঞ্জ পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমান বলেন, বাল্যবিবাহ নামের সামাজিক ব্যাধিতে এই উপজেলার অনেক সম্ভাবনাময় ছাত্রী অকালে ঝরে পড়ছে। এসব মেয়ের অধিকাংশ অষ্টম শ্রেণির গণ্ডি পেরোতে পারছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুড়াহার গ্রামের এক অভিভাবক বলেন, ‘কন্যাশিশুকে নিয়ে অভিভাবকেরা সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। আমি পরীক্ষার আগে হঠাৎ করে ভালো একজন পাত্র পাওয়ায় অল্প বয়সেই মেয়ের বিয়ে দিতে বাধ্য হলাম।’
আটমূল বিরাজ উদ্দিন দাখিল মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট এমদাদুল হক বলেন, ‘এই উপজেলায় অভিভাবকদের কাছে মেয়েদের পড়াশোনা খুব একটা গুরুত্ব পায় না। মেয়েদের শুধু বিয়ের জন্য পড়াশোনা করানো হয়। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ৯৯ শতাংশ ছাত্রীর ঝরে পড়ার কারণ বাল্যবিবাহ।’
জানতে চাইলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘ফরম পূরণ করার পরও পরীক্ষায় অংশ না নেওয়ার প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ। এ ছাড়া অভিভাবকদের অসচেতনতাও রয়েছে।’
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করে উপজেলা কমিউনিটি পুলিশিং কমিটি। এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও শিবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘এই উপজেলায় উদ্বেগজনক হারে বাল্যবিবাহ হচ্ছে। আমরা বিভিন্নভাবে এটি বন্ধ করার চেষ্টা করছি। এ জন্য শিক্ষকসহ বিভিন্ন মহল থেকে আরও সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে।’
তারাগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলায় ৩৩টি মাধ্যমিক, নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল ও মাদ্রাসা আছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে এবার ২ হাজার ৭৪ জন শিক্ষার্থী জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করে। তাদের মধ্যে ১ নভেম্বর প্রথম পরীক্ষায় ৫৭ জন অনুপস্থিত ছিল। এদের মধ্যে ২৭ জন ছাত্রী ও ৩০ জন ছাত্র।
পরীক্ষাকেন্দ্রের সচিব ও তারাগঞ্জ ও/এ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলতাফ হোসেন বলেন, ‘বাল্যবিবাহের কারণে এলাকার অনেক মেয়ে শিক্ষাজীবনের মাঝপথে ঝরে পড়ছে। ১০ জন ছাত্রীর বিয়ে হওয়ায় তারা জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়নি বলে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি।’
ইউএনও জিলুফা সুলতানা বলেন, ‘বিভিন্ন সভা-সমাবেশে মানুষকে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। এর কুফল সম্পর্কে গ্রামবাসীকে সচেতন করতে ইউপি চেয়ারম্যানদের পরামর্শ দিয়েছি। স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রশাসনকে জানালে অবশ্যই এসব বাল্যবিবাহ বন্ধ করা যেত।’