দেশের ব্যাংক খাত দিন দিন নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। ৪৮টি ব্যাংকের মধ্যে ১৩টির আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অনেক বেড়ে গেছে। সুশাসনের অভাবে বেড়েছে ঋণ অনিয়ম, যা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থা আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমনকি দুই বছর ধরে এই ১৩ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।
দেশে সরকারি-বেসরকারি-বিদেশি মিলে মোট ৫৭টি ব্যাংক রয়েছে। আর্থিক অবস্থার অবনতি হওয়া ১৩টি ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও বিশেষায়িত ব্যাংকই আটটি। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স, ন্যাশনাল, ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়ালে পরিস্থিতি কয়েক বছর ধরে খারাপ হচ্ছে। এ ছাড়া এক যুগ আগে বিলুপ্ত হওয়া ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের দুর্নীতির বোঝা এখনো টেনে চলেছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। বাকি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগের অবস্থাও সন্তোষজনক নয়।
বেসরকারি খাতের একাধিক ব্যাংকের মালিকানা বদল নিয়ে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটলেও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে সায় দিয়েছে। ফলে ব্যাংক খাতের আমানতকারীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে।
ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চোখের সামনে ২০১১ সালের পর থেকে বেসিক ব্যাংকের মতো লাভজনক ব্যাংক সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। সঠিক দলিলপত্র যাচাই না করে ঋণ দেওয়া এবং আইন না মেনে একক গ্রাহককে সীমার বাইরে ঋণ দেওয়ার উদাহরণ রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে এখন খুবই সাধারণ ঘটনা। এতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ, দায় পড়ছে জনগণের ওপর। এ কারণে করের টাকা থেকে সরকার এ ব্যাংকগুলোকে প্রতিবছর বড় অঙ্কের মূলধন জোগান দিচ্ছে।
এ অবস্থায় আবারও নতুন করে কয়েকটি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এর বাইরে বাংলাদেশ পুলিশ নতুন একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে।
ব্যাংক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশে পুরো ব্যাংক খাতের পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, যে কারণে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এত ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এ জন্যই নতুন ব্যাংকগুলোর অবস্থাও দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’
সম্প্রতি ব্যাংক মালিকদের চাপে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ সংশোধনী চূড়ান্ত হলে তাতে কয়েকটি পরিবারের মধ্যে ব্যাংকের মালিকানা কুক্ষিগত হয়ে পড়বে। কারণ, আইন সংশোধন করে ব্যাংকের পর্ষদে একই পরিবার থেকে চারজন এবং একটানা নয় বছর দায়িত্ব পালনের সুযোগ রাখা হচ্ছে। যদিও এরই মধ্যে চট্টগ্রামভিত্তিক একটি ব্যবসায়ী পরিবারের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে কয়েকটি ব্যাংক।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত ১৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ব্যাংক খাত ভালো চলছে না। তিনি নিজেও মনে করেন এ জন্য দায়ী মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল তদারকি ব্যবস্থা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ
রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী—এ চার ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গত ১২ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা (এমডি) উপস্থিত ছিলেন।
ওই বৈঠকের কার্যবিবরণীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করে ব্যাংকগুলোর পর্ষদে ঋণ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন এমডিরা। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং নীতি ও প্রবিধি বিভাগের (বিআরপিডি) প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পর্ষদে যেকোনো ঋণ প্রস্তাব উপস্থাপনের আগে এমডির দায়িত্ব হচ্ছে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ব্যত্যয় ঘটছে কি না, তা যাচাই করা। অথচ বড় বড় কিছু গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও আইনকানুন মানা হচ্ছে না। নির্ধারিত ঋণসীমার অতিরিক্ত ঋণ দেওয়া হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে কিছুদিন না যেতেই সেসব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণ জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান লোকে বলেন, ‘আমি শুধু এটুকু বলব যে ব্যাংকগুলোর আরও ভালো করার সুযোগ আছে এবং সে জন্য কিছু উদ্যোগও নিয়েছি।’
বেসরকারি ব্যাংকে পরিবর্তন আতঙ্ক
বিশেষ ব্যবস্থায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংক এবং অক্টোবরে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তনের পর এখন ব্যাংক খাতে একধরনের পরিবর্তন আতঙ্ক বিরাজ করছে। চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ চলতি বছরে এ দুটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালে বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব আবদুল মান্নানের শেয়ার কিনে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ। তাতেও ব্যাংকটির উন্নতি হয়নি। বর্তমানে ব্যাংকটির মোট ঋণের ৩৪ শতাংশই খেলাপি। জানুয়ারিতে বড় পরিবর্তনের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ এস আলম গ্রুপের হাতে যাওয়ার পর ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। কমে গেছে আয় ও আমানতের প্রবৃদ্ধি।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া ব্যাংক খাত সঠিকভাবে চলবে না। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে আইন প্রয়োগের স্বাধীনতা এবং সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকের ওপর পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার দিতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংক খাতকে ঠিক করা যাবে না।
অনিয়ম আছে, শাস্তি নেই
প্রায় চার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতির নেপথ্যে থেকেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার বড় উদাহরণ হচ্ছে বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)—কেউই কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি তাঁর বিরুদ্ধে।
ফারমার্স ব্যাংকে তারল্য সংকট তীব্র। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে না পারায় গত এক বছরে সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জরিমানা দিয়েছে এই ব্যাংক। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের মূলধন সরবরাহ থেকে ঋণ দেওয়া—সব ক্ষেত্রেই বড় ধরনের অনিয়মের চিত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ধরা পড়েছে। এসব অনিয়মের ঘটনায় বিচারের সর্বশেষ ধাপ হিসেবে ব্যাংকটির এমডি দেওয়ান মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত শুনানি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু চেয়ারম্যান এম ফরাছত আলীর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ গত জুন পর্যন্ত হয়েছে ২ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা, যা মোট দেওয়া ঋণের প্রায় ১১ শতাংশ। খেলাপি গ্রাহকদের থেকে ব্যাংক কোনো অর্থ আদায় করতে পারছে না, আইনি ব্যবস্থাও নিতে পারছে না। প্রায় নয় মাস ধরে ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়ে চলছে ব্যাংকটি। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী তিন মাসের বেশি ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়ে ব্যাংক পরিচালনার সুযোগ নেই। এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ন্যাশনাল ব্যাংকের বেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকটাই নীরব।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, ‘এটা ঠিক যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থা আরও নিখুঁত হলে ব্যাংক খাতের জন্য ভালো হতো। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুই করছে না, এ অভিযোগও ঠিক নয়। ফারমার্স ব্যাংককে জরিমানা করা হয়েছে, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের দায়ীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আরও যেখানে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, যত দূর সম্ভব সবই নেওয়া হচ্ছে।’
তবে ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সব হচ্ছে। তাতে ব্যাংক খাতে অনিয়মের ঘটনা বাড়লেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সবার আগে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
মোট খেলাপি ঋণ ৭৪,১৪৮ কোটি টাকা (১০.১৩%)
অবলোপনকৃত ঋণ-৪৫,০০০ কোটি টাকা
ব্যাংক | খেলাপি ঋণ | জুন ১৭ | জুন ১৬ |
সোনালী | ১১,৪২১ | ৩৪.৫০% | ৩০.২২% |
অগ্রণী | ৪,৯০৪ | ১৯.৯৯% | ২২.৪৭% |
জনতা | ৫,৩৪০ | ১৪.০২% | ১৭.২৯% |
রূপালী | ৪,৭৫৯ | ২৬.৯৩% | ১৫.৩১% |
বেসিক | ৭,৩৯০ | ৫২.৯৯% | ৫২.৮৩% |
বিডিবিএল | ৭৬৪ | ৫২.০৭% | ৫০.৪৬% |
কৃষি | ৪,৩১৫ | ২৩.৫৭% | ২৭.৫১% |
রাজশাহী কৃষি | ১,২০২ | ২৪.৬৩% | ২০.২৯% |
কমার্স | ৫৯৭ | ৩৪.১৪% | ৩১.৬০% |
ন্যাশনাল | ২,৪৪৩ | ১০.৮৪% | ৮.৩৪% |
আইসিবি | ৭০৭ | ৭৬.৫২% | ৭৬.৩৯% |
ফারমার্স | ৩০৬ | ৬.৩৫% | ৬.৪০% |
এনআরবিসি | ১৯১ | ৪.৯৫% | ২.৯৬% |