দুই বছর আগে যখন যুবরাজ হিসেবে মোহাম্মদ বিন সালমানের আবির্ভাব ঘটে, তখন অনেকের অনুমান ছিল, সৌদি শাসনতন্ত্রে পরিবর্তনের সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। কিন্তু গত রবিবার যা ঘটল, তা ছিল দ্রুতগতির চেয়েও বেশি কিছু; অনেকটা ভূমিকম্পের মতো।
এই কম্পনের তীব্রতা এতটাই যে তা ছাড়িয়ে গেছে সৌদি সীমানাও। বিশ্লেষকরা বলছেন, সৌদি যুবরাজের ক্ষমতার খেলা কেবল ঘরের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই খেলা চলছে সৌদি চৌহদ্দির বাইরেও।
সৌদি আরবে ক্ষমতার যে খেলা চলছে, তা শুরু হয় মূলত গত শনিবার সন্ধ্যায়, যখন ‘প্রাণভয়ে’ পদত্যাগের ঘোষণা দেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি। এই ঘোষণা তিনি দেন সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে বসে। এর কয়েক ঘণ্টা পর সৌদির সরকারি সংবাদ সংস্থার খবরে বলা হয়, তাদের সেনাবাহিনী রিয়াদের উদ্দেশে নিক্ষেপ করা ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের একটি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে।
এসব ঘটনার পরপরই খবর আসে, দুর্নীতির অভিযোগে প্রিন্স আলওয়ালিদ বিন তালাল ও ১১ যুবরাজসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রীকে যুবরাজ সালমানের নির্দেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বরখাস্ত করা হয়েছে নৌপ্রধানকে। এখানেই শেষ নয়, গত রবিবার ইয়েমেনের সীমান্তে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে মৃত্যু হয় মানসুর বিন মুকরিন নামের এক প্রিন্সের।
যদিও হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ এখনো জানা যায়নি। এ ছাড়া গতকাল দেশটির সর্ববৃহৎ পর্যটন কম্পানি ‘আল-তায়ার ট্রাভেল’এর প্রতিষ্ঠাতা নাসের বিন আকিল আল-তায়ারকে আটক করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সৌদিতে যা ঘটছে, তা মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতপূর্ণ ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায় রচনা করতে যাচ্ছে। তাঁরা বলছেন, দীর্ঘ সময় ধরে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে যে ছায়াযুদ্ধ চলছে, এসব ঘটনা সেই ছায়াযুদ্ধকে আরো উসকে দেবে।
গত শুক্রবার ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস (ইসলামিক স্টেট) জঙ্গিগোষ্ঠীর সর্বশেষ ঘাঁটির পতন ঘটে। ফলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে নতুন করে স্বার্থের হিসাব কষতে হচ্ছে। সৌদি আরব এসব আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে অন্যতম।
৩২ বছর বয়সী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ক্ষমতার খেলার সঙ্গে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হারিরির পদত্যাগের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। হারিরি গত শুক্রবার যখন সৌদি আরবে যান, সেটি ছিল সাত দিনের মধ্যে তাঁর দ্বিতীয় সৌদি সফর। সপ্তাহখানেক আগে প্রথম সফরে সৌদির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। বৈঠকে আলাপ হয় লেবাননের হিজবুল্লাহকে নিয়ে, যেটি ইরানপন্থী সংগঠন এবং লেবানন সরকারের একটি অংশ। হিজবুল্লাহকে নিয়ে সৌদির মধ্যে যে ভয়ভীতি রয়েছে, ওই বৈঠকে মূলত সেসব ভয়ভীতির ব্যাপারে সৌদিকে আশ্বস্ত করেন হারিরি। বৈঠক শেষে লেবাননে ফেরার পর তাঁকে অনেকটা নির্ভার মনে হয়েছিল অনেকের কাছে। তাঁদের একজন হিজবুল্লাহপন্থী সংসদ সদস্য ইয়াসির জাবের। সিএনএনকে তিনি বলেন, ‘প্রথম সফর থেকে ফেরার পর তাঁকে (হারিরি) বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল। ’
কিন্তু গত শুক্রবার যখন হারিরি ফের সৌদি আরব যান, তখন সব পরিস্থিতি পাল্টে যায়। হিজবুল্লাহ ও ইরানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করে নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন তিনি। উল্লেখ্য, হারিরির দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে এবং সৌদি আরব তাঁর অন্যতম রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক। ফলে এটা অনেকেই নিশ্চিত যে লেবানন ইস্যুতে সৌদি আরবের নতুন ছকের হিসাব মেলাতেই হারিরিকে পদত্যাগ করানো হয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট অ্যান্ড গাল্ফ মিলিটারি’র পরিচালক রিয়াদ খাওয়াজি বলেন, হারিরির পদত্যাগের মধ্য দিয়ে লেবাননের ৩০ সদস্যের জাতীয় ঐক্যের সরকার ভেঙে যাবে। এ ছাড়া ইরানের সঙ্গে বিশ্বশক্তির করা চুক্তির ফলে যতটুকু অস্থিরতা কমেছিল, তা আবার বেড়ে যাবে।
হারিরির পদত্যাগ নিয়ে কথা বলা শুরু করেছেন অন্যরাও। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক টুইটার বার্তায় বলেছেন, হারিরির পদত্যাগ ‘ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার একটি ডাক’।
ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ : ধারণা করা হচ্ছে, রিয়াদের উদ্দেশে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা যে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, তার সঙ্গে সৌদির ক্ষমতার পালাবদলের সম্পর্ক রয়েছে। হুতিদের বিরুদ্ধে কয়েক বছর ধরে লড়াই চালিয়ে আসছে সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন জোট। অন্যদিকে হুতিদের অস্ত্রসহ নানা ধরনের সহযোগিতা দিয়ে আসছে ইরান।
হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত : ইয়েমেন সীমান্তের কাছে গত রবিবার রাতে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন প্রিন্স মানসুর বিন মুকরিন। তিনি একটি প্রদেশের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন। দুর্ঘটনার সময় ওই হেলিকপ্টারে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাও ছিলেন। তবে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ এখনো জানা যায়নি। সূত্র : সিএনএন,