ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইনের পর কুমিল্লার মাদকসেবিদের নেশার তালিকায় চাহিদা বেড়েই চলেছে ক্রেজি মেডিসিন নামে খ্যাত ইয়াবা ট্যাবলেটের। কুমিল্লায় কম করে হলেও একলাখ কিশোর, তরুণ, যুবকের পছন্দের নেশার জায়গাটি দখল করে নিয়েছে ইয়াবা। আর ইয়াবার আগ্রাসনে হুমকির মুখে তারুণ্য। ইয়াবার নেশা সমাজে অপরাধও বাড়াচ্ছে। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, খুনের ঘটনাও ঘটছে। কুমিল্লার চারিদিকে মাদকের ছড়াছড়ি। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্ররাও ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ আইন শৃংখলা বাহিনী প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমান ইয়াবা আটক করলেও এটির চালান আসা বন্ধ হচ্ছেনা। কুমিল্লার মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে যারা চিকিৎসা নিচ্ছে বা ভর্তি হতে আসছে ওদের বেশিরভাগই ইয়াবার নেশায় আসক্ত। সমাজের সচেতন শ্রেণির লোকজন উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, মাদকের সহজ লভ্যতা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণসহ অনিয়ন্ত্রিত পারিবারিক জীবন-যাপনের কারণে কুমিল্লায় ইয়াবাসহ অন্যান্য আসক্তের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন জেলার ন্যায় কুমিল্লাতেও ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে। মাদকের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারি সংস্থাগুলো জিরো টলারেন্স প্রদর্শন করছে ঠিকই। কিন্তু দমানো যাচ্ছে না ইয়াবার আগ্রাসন। একদিকে জোরালো অভিযান, অন্যদিকে ইয়াবার ওপেন সিক্রেট বেচাকেনা। কুমিল্লায় অন্তত এক হাজার মাদক ব্যবসায়ি রয়েছে, যাদের মধ্যে সাতশোর বেশি ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকা এসব ব্যবসায়িরা ইয়াবার খুচরা বিক্রির জন্য নারী, পুরুষ ও শিশুসহ প্রায় পাঁচশো লোক নিয়োজিত রেখেছে। গত কয়েক বছরে কুমিল্লায় ফেন্সিডিল, হেরোইন, গাঁজাসহ অন্যসব মাদককে পেছনে ফেলে ব্যাপকহারে বেড়েছে ইয়াবার ব্যবহার। সহজে বহনযোগ্য ইয়াবা ট্যাবলেট এখন বেশ সহজেই হাতের নাগালে পাচ্ছে মাদকসেবীরা। ইয়াবাসেবীদের কাছে এটি ‘ক্রেজি মেডিসিন’। বর্তমানে যুব ও তরুণ সমাজের কাছে মাদক হিসেবে পছন্দের শীর্ষে রয়েছে ইয়াবা। পাশের দেশ মিয়ানমারে উৎপাদিত মরণনেশা ইয়াবা টেকনাফ-কক্সবাজার-চট্টগ্রাম হয়ে স্্েরাতের মতো আসছে কুমিল্লায়। ইয়াবাকে কেন্দ্র করে মাদকখাতে সবচেয়ে বেশি টাকা পাচারও হচ্ছে মিয়ানমারে।
বর্তমানে মাদক নির্ভরতাদের মধ্যে কুমিল্লার তরুণ-যুব সমাজের বেশিরভাগই ইয়াবাসেবি। গন্ধবিহীন ইয়াবা নামের লাল, নীল, সবুজ রংয়ের গোলাকার ছোট ট্যাবলেট এখন সমাজের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত পর্যায়ের তরুণ, যুবক এবং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছেও প্রিয় নেশায় পরিগণিত হয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে ইয়াবাসহ কুমিল্লা কোতয়ালী থানায় চারজনকে আটক করে নিয়ে আনে পুলিশ। ওরা স্কুল ও কলেজের ছাত্র। ওসি তদন্ত সালাউদ্দিনের কক্ষে যখন ওদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তখন বেরিয়ে আসে ইয়াবা সেবনের আদ্যোপ্রান্ত। ঘরের ভেতরে ইযাবা সেবনের ভিডিও ধারণও পাওয়া গেছে ওই ছাত্রদের মোবাইল ফোনে। অভিভাবকরা খবর পেয়ে থানায় এসে পুলিশকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লেন- তাদের সন্তানরা মেধাবী ছাত্র, ভদ্র ন¤্র। কিন্তু মোবাইল ফোনে সন্তানদের নেশা গ্রহণের ভিডিও দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েন অভিভাবকরা। পরে ইয়াবাসেবি ছাত্রদের কোর্টে চালান দেয়া হয়।
সেবনকারিদের কাছে ইয়াবা বাবা নামেও পরিচিতি পেয়েছে। যারা একসমসয় দেদারসে ফেন্সিডিল সেবন করতো তাদের একটি বড় অংশ এখন ইয়াবায় আসক্ত। গত কয়েক বছর ধরে ইয়াবার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এধরণের নেশায় আসক্তের সংখ্যা অবিশ্বাস্যহারে কুমিল্লায় বেড়ে চলেছে। কুমিল্লায় আইন-শৃংখলাবাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার মধ্যেও প্রতিদিন বিপুল পরিমান ইয়াবা কুমিল্লায় আসছে। কুমিল্লার পুলিশ, বিজিবি, র্যাবের হাতে ইয়াবাসহ আটক হওয়ার ঘটনাও কম নয়। তারপরও এখানে থামছে না ইয়াবার বিস্তার। কুমিল্লার মাদকাসক্তি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সেখানে চিকিৎসার জন্য যারা ভর্তি হচ্ছে তাদের মধ্যে ৯০ভাগই ইয়াবাসেবী। দর্পণ মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পূনর্বাসন কেন্দ্রের পরিচালক গোলাম মহিউদ্দিন জীবন জানান, ‘আমাদের এখানে বর্তমানে যারা চিকিৎসা নিচ্ছে এদের বেশির ভাগই ইয়াবায় আসক্ত। মরণনেশা ইয়াবার বিষে কুমিল্লার হাজার হাজার তরুণ-যুবকের স্বপ্নময় জীবন নীল হয়ে যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি চিকিৎসাসেবা ও যথাযথ কাউন্সিলিং দিয়ে সুস্থ স্বাবাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে।’ জানতে চাইলে মানোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. মহাদেব চন্দ্র মন্ডল বলেন, ‘কুমিল্লায় একটি মাদকাসক্তি চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রতিমাসে আমি ঢাকা থেকে রোগী দেখতে আসি। এখানে ইয়াবায় সবচেয়ে বেশি আসক্ত তরুণ যুবকরা। যাদের অনেকেই শিক্ষার্থী। কুমিল্লায় মাদকের যে বিস্তার এটা রাজনৈতিক বা অন্য কোন সংকটের চেয়েও ভয়াবহ।’
কুমিল্লার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা জানান, এখানে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক আগ্রাসন তারুণ্য, মেধা, বিবেক, মনুষ্যত্ব সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। পারিবারিক অশান্তি বাড়ছে। বিনিষ্ট করে দিচ্ছে ¯েœন, মায়া-মমতা ও পারিবারিক বন্ধন। মাদকের এ ভয়াবহতা প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন জোরদারের বিকল্প নেই। কুমিল্লার সব রাজনেতিক দল, শ্রেনি-পেশার মানুষকে মাদকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার শপথ নিতে হবে। নয়তো আগামীদিনে কুমিল্লাবাসীর জন্য মাদক আগ্রাসন বড় ধরণের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।