‘বাজার থেকে সাহেব এলেন কোট-প্যান্ট পরে/ কোট-প্যান্ট খুলতে গেলে চোখ জ্বালা করে।’ এই ধাঁধার জবাব খুঁজতে গেলে অনেককেই মাথা চুলকাতে হয়। কারণ, ভদ্রলোকটি যে পেঁয়াজ, সহজে কারও মাথায় খেলে না। এ মুহূর্তে এই ভদ্রলোক কেবল পোশাকেই নয়, দামেও জ্বালা ছড়াচ্ছে। বাজারে একটি পেঁয়াজের দাম এখন পাঁচটি টাকা—ভাবা যায়? অথচ এই পেঁয়াজ না হলে আমাদের দিন চলে না। বললাম বটে, আসলে কি তা-ই?
ধরুন, মাছ-মাংসে পেঁয়াজ লাগবেই। তা ঝোল বা মাখো মাখো ভুনা করুন, পেঁয়াজ ছাড়া কি আর ব্যঞ্জন সুস্বাদু হয়। সালাদে পেঁয়াজ না হলে জমে না। মুচমুচে মাছ ভাজা? সেও তো কাঁচা পেঁয়াজের ফালি কচর কচর করে না চিবোলে হয় না। আমাদের ভেতো জীবনে পেঁয়াজকে পাশ কাটিয়ে চলার জো কোথায়? গরমের পান্তা বা শীতের কড়কড়ে ভাত, সে ওই মরিচের সঙ্গে পেঁয়াজের জুটি না হলে কি চলে? আর শাহি খানাদানায় পেঁয়াজ-ঘিয়ের ঘন ঝোল এড়াবেন কী করে? পোলাওয়ের ওপর একটুখানি পেঁয়াজের বেরেস্তা না দিলে মুখই রোচে না। পবিত্র রমজানের ইফতারে পিয়াজুসহ রকমারি অনেক খাবারেই পেঁয়াজের দেদার ব্যবহার রয়েছে।
সর্দিতে বন্ধ নাক পেঁয়াজের ঝাঁজে চিচিংফাঁক। পেঁয়াজের রস গরম পানির সঙ্গে কুলকুচো করলে গলাব্যথায় আরাম মেলে। ইতিহাস বলে, রোমান সম্রাট নিরো ঠান্ডা সারাতে পেঁয়াজ খেতেন। পেঁয়াজ ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ ও বহুমূত্র রোগ ঠেকাতে সহায়তা করে। ভারতে অনেক ট্যাক্সিচালককে গাড়িতে পেঁয়াজ ঝুলিয়ে রাখতে দেখেছি। পেঁয়াজ পয়মন্ত।
পেঁয়াজ খালি খায়ই না, মাথায়ও দেয়। পুষ্টিবিদেরা বলেন, পেঁয়াজের রস মাথায় দিলে চুল পড়া কমে। কাটা-ছেঁড়া বা ক্ষতে পেঁয়াজের রস ব্যবহারের কথা শোনা যায়। ওই যে ঝাল ঝাড়তে বলে না—‘বিষপিঁপড়ার মতো এমন কামড় দিমু, পেঁয়াজের রস দিয়াও পার পাইবা না!’
শৈশবে স্কুলে পড়ার সময় বন্ধুদের মধ্যে একটা গুঞ্জন ছিল—পেঁয়াজ ছিলে বগলের তলায় রাখলে শরীর গরম হয়। স্কুল কামাই দিতে জ্বরের অছিলা খাড়া করতে তাই পেঁয়াজ এক মোক্ষম দাওয়াই। এ কৌশল অবশ্য কখনো অ্যাপ্লাই করার সুযোগ হয়নি। তাই এ গুঞ্জন কতটা সত্য—বলতে পারছি না। আবার ‘পেঁয়াজের খেপ’ বলেও একটা কথা শোনা যায়, যে খেপ মারতে গেলে মানুষ আর ফিরে আসে না। ওই ‘পটল তোলা’ আরকি।
তাই বলে পেঁয়াজ যে সবাই দেদার পছন্দ করে, তা নয়। অনেকে পেঁয়াজের গন্ধটা একদম সইতে পারে না। কারও পেটে পেঁয়াজ পড়লেই গ্যাসের বুদ্বুদ ওঠে। কোনো কোনো রীতিতে পেঁয়াজ খাওয়া বারণ।
পেঁয়াজ নিয়ে তেমন একটা কৌতুকও আছে: এক বামুনের মেয়ের বিয়ে হবে। ছেলে সম্পর্কে বাবা খোঁজ নিচ্ছেন ঘটকের কাছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছেলের কোনো বদভ্যাস নেই তো?’
ঘটক বলল, ‘না, ওই মাঝেমধ্যে একটু পেঁয়াজ খায় আরকি!’
‘এ্যাঁ, বলো কী!’
‘না, পেঁয়াজ তো আর সব সময় খায় না। যখন গোমাংস খায়, তখন।’
বামনের তো এবার মাথায় হাত।
ঘটক তাঁকে আশ্বস্ত করতে বলল, ‘গোমাংস তো আর যখন-তখন খায় না, ওই একটু মদ্যপান করলে।’
পেঁয়াজ নিয়ে এটা কাল্পনিক কৌতুক বটে, বাস্তবে আদরের এই কন্দটি তার ভোক্তাদের সঙ্গে দাম নিয়ে রসিকতা করছে, তা অতি নির্মম। বাজারে যে পেঁয়াজ ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি হওয়ার কথা, সেই পেঁয়াজের দাম ধাঁ ধাঁ করে বেড়ে যাচ্ছে। কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা বা তারও বেশি দামে।
সংবাদপত্রের তথ্য (প্রথম আলো) বলছে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১৭ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। এর বাইরে ৫ থেকে ৬ লাখ টন আমদানি করা হয়। যার বেশির ভাগ আসে ভারত থেকে। বছরের শেষ দিকে এসে প্রতিবারই পেঁয়াজের দাম বাড়ে। তবে এবার অনেক বেশি বেড়েছে। গত আগস্ট মাসে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা ও ভারতীয় পেঁয়াজ ৫৫ টাকায় উঠেছিল। এরপর ভারতের সঙ্গে মিলিয়ে দেশেও দাম কমে যায়। ভারতের বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতি মাসের শুরু থেকে আবার দাম বাড়তে থাকে।
প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবরের তথ্যমতে, ভারতের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার লাসালগাঁওয়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ২৮ রুপিতে উঠেছে, যা দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দর। এ কারণেই আমাদের দেশের পেঁয়াজের বাজারও এখন চড়া। তাই পেঁয়াজ এখন কোট-প্যান্ট পরা ভদ্রলোকই বটে! যার নাগাল পাওয়া সহজ নয়। কিন্তু দেশের বাজারে দামের পাগলা ঘোড়ায় পেঁয়াজের সওয়ার হওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। দেখা যায়, বর্ষা বা শীতের আগে, ঈদের মতো বড় কোনো উৎসবের আগে আচমকা লাফিয়ে ওঠে পেঁয়াজের দাম। এই সংকট মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি কি নেওয়া যায় না? দেশের হিমাগারে অনেক পচনশীল খাবার বা খাবারের উপকরণ মজুত রাখা হয়। এ ধরনের সংকটের কথা ভেবে কি আগে থেকে পেঁয়াজ সেভাবে মজুত রাখা যায় না।
পেঁয়াজ আমদানির বেলায়ও ভারতের ওপর ব্যাপক নির্ভরতা কমানোর বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। সুদূর মিসর থেকে যদি পেঁয়াজ আনা যায়, তাহলে চীন বা নিকটবর্তী অন্য কোনো দেশ, যেখান থেকে পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ রয়েছে, সেটা বিবেচনা করা দরকার। চালের মতো পেঁয়াজ মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি মুনাফাখোর একশ্রেণির মজুতদার ফায়দা লুটছে কি না, সেটাও ভালো করে খতিয়ে দেখা দরকার।
আর পেঁয়াজের ওই দামের পাগলা ঘোড়া কিছুতেই যদি বশ না মানে, তাহলে অন্য ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সে ব্যবস্থা নিজের হাতেই। পেঁয়াজ খেতেই হবে, এমন নয়। ডাল বা সবজির ফোড়নে পেঁয়াজ না দিলে কী হয়? স্বাদ বাড়ানোর জন্য কেবল পাঁচফোড়ন বা অন্য কোনো বিকল্প উপায় কি নেই? ভাজি-ভর্তা-ভুনায় পেঁয়াজ একটু কম খেলে কিছুই হবে না। মাছ-মাংসে পেঁয়াজ বাটা বা কুঁচি না দিলেই-বা ক্ষতি কী? এটা তো ভাত নয় যে না খেয়ে মারা যাব। পেঁয়াজের দাম নিয়ে হাহুতাশ না করে বরং পেঁয়াজ ব্যবহারে সংযমী হলে ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করি। দাম কমবে না—যাহ, খেলাম না পেঁয়াজ!