ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে প্রায় তিন মাস পর নিজেদের গ্রামে ফিরে এসেছে শিশু নীলিমা চাকমা। প্রথমে চিনতে পারেনি তাদের গ্রাম, পাড়া, ঘোনা! শুধু নীলিমা কেন? তার অজু (নানা), নানু, বাবা, মা, কেউই চেনা প্রতিবেশ-পরিবেশ ফিরে পায়নি। এক অচেনা গা-ছমছম তল্লাটে তাদের ফিরে আসতে হয়েছে। পাহাড়ধসে ঘরবাড়ি হারানোর পর প্রাণ বাঁচানোর জন্য সবাই ছুটে গিয়েছিল নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। সবার প্রাণ বাঁচেনি সে রাতে। মা-বোনকে মাটির নিচে রেখেই ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রাণটুকু নিয়ে গ্রামের মানুষের সঙ্গে ছুটতে হয়েছিল মণিকাকে (১৩)।
ছোট বোন বন্দনাকে (৮) জড়িয়ে শুয়ে ছিল মণিকা। বৃষ্টির সঙ্গে বাজ পড়লে তার খুব ভয় করে। ঘুম আসে না। বন্দনা ঘুমিয়ে যায়। একসময় মা শান্তি সোনার সাড়াশব্দ পায় না আর! শুধু মেঘ আর বাজের কলিজা চেরা আওয়াজ। বাবা বাড়ি নেই। বাবা থাকলে সে একটু সাহস পায়, কিন্তু বাবা চাটগাঁ থেকে আজও ফিরল না। এসব ভাবতে ভাবতে তার চোখ দুটো যখন বুজি বুজি করছে, তখন শোনে, কে যেন ডাকছে—মণি মণি। প্রথমে মনে হয়েছিল বাবা ডাকছে। কিন্তু বাবা তো বন্দনাকে ডাকে আগে। বন্দে বন্দে বলে চিৎকার করে আগে। তাকে না পেলে তারপর ডাকে মণিকাকে। আধো ঘুম, আধো জাগা অবস্থায় মণিকা শোনে অনেক মানুষের পায়ের শব্দ। এবার জীবন আজুর (নানা) গলা চিনতে পারে। একবার ডাকে মণি। তারপর তার মাকে—শান্তি, ও শান্তি। মণি, মণিকা, শান্তি সোনা। মণিকা এক লাফে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ায়। তারপর আর কিছু মনে করতে পারে না। সামনের বাড়ির জীবন চাকমা, যাঁকে মণিকারা নানা বা অজু বলে ডাকত, তিনি তাকে কোনোমতে মাটির গাদা থেকে বের করে ছুটতে থাকেন। পেছনে মাটির গভীরে চাপা পড়ে থাকে মণিকার মা আর ছোট বোন বন্দনা। দুদিন পরে গ্রামের মানুষ ফিরে এসে মা ও বোনের লাশ উদ্ধার করে। মণিকা তখন হাসপাতালে। মা-বোনকে আর কোনো দিন সে দেখতে পাবে না।
বাবা কবে ফিরেছে, তার মনে নেই। মণিকা স্কুলে ফিরেছে। এক আত্মীয়ের বাসায় থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে (?)। সেই তুলনায় নীলিমা অনেক ভাগ্যবতী। তাদের বাড়িটা একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গেলেও তারা সবাই বেঁচে আছে। অন্যের জমিতে ঘর তুলেছে তার বাবা। দুই বান্ডিল ঢেউটিন আর ছয় হাজার টাকা দিয়ে তাদের আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। যে যেখানে পারো, চলে যাও। কোথায় যাবে জানি না, তবে খেয়াল রেখো যেন আবার পাহাড়ের তলায় চাপা না পড়ো।
এর আগে কিন্তু প্রশাসন কথা দিয়েছিল। সংবাদ সম্মেলন করে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিল; ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য একটা টেকসই পুনর্বাসন প্রয়োজন। এই জন্য তাড়াহুড়ো না করে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। আবেগাপ্লুত কর্মকর্তা আরও বলেছিলেন, ভবিষ্যতে যেন আর কোনো পাহাড়ধসের ঘটনায় কোনো মৃতদেহ দেখতে না হয়। তিন মাস যেতে না যেতে প্রশাসন চোখের নিমেষে হাওয়া হয়ে গেল। সেই ভাঙা পাহাড়ের কাঞ্চি ঘেঁষেই থাকছে নীলিমা, সান্ত্বনা, অরুণ, আবুল, জবা, কলিম, ধ্বনি। তারা সবাই যেন প্রতিধ্বনি তুলছে—কেমনভাবে বেঁচে আছি, তুই এসে দেখে যা। এ-ই কি মানুষজন্ম?
ছয় হাজার টাকা আর দুই বান্ডিল টিনে কি ঘর হয়? ধারকর্জ করে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকায় নীলিমার বাবা-কাকা মিলে একটা দোচালা ঘর তুলেছে। অনেকেই থেকে গেছে অন্য আত্মীয়ের বাসায়, প্রতিবেশীর ঘরে। ঘর-দুয়ার আর ভাঙা পাহাড়ের ঝুঁকি ছাড়াও জীবিকা এখন একটা বড় প্রশ্ন। ধসের পর রাঙামাটি সদরের কিনামনিরঘোনা এলাকার প্রায় সব চাষযোগ্য জমি এখন দুই-তিন হাত বালুর নিচে চাপা পড়ে আছে। একই ছবি এখন পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সব কটি এলাকায়। সাপছড়ি ইউনিয়নের নারাইছড়ি এলাকার ১১৭ পরিবারের কারও জমি এখন আর চাষযোগ্য নেই। এসব মানুষের প্রধান আয়ের উৎসই ছিল কৃষিকাজ। ( পাহাড়ধসের পরপর গত ১২ জুলাই শেষ পাতায় এই পরিস্থিতির বিষয়ে আলোকপাত করেছিল)।
কিনামনিরঘোনায় যেখানে এখন কথা না রাখা প্রশাসনের চাপে বাধ্য হয়ে নীলিমার বাবা, কাকা, অজু, দাদুরা ফিরে এসেছে। সেটা দেখে মনে হবে, দুই পাহাড়ের মাঝে যেন একটা ভ্যালি। জীবন চাকমা বললেন, এটা কোনো ভ্যালি নয়, স্রেফ গর্ত। পাহাড় ভেঙে তৈরি হওয়া গর্ত। দুই দিকের পাহাড়ের ধ্বংসাবশেষ খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি হলেই ভয় হয়। ১৩ জুনের কথা মনে পড়ে। ভয় আর আতঙ্কের সঙ্গে ঘর করা সহজ কাজ নয়। এ যেন বাধ্য হয়ে সাপের খাঁচায় রাত কাটানো। এক-দুইটা না, জীবনের বাকি সব কয়টা দিনরাত্রি আতঙ্কের মধ্যে পার করতে হবে। এসব কেমন দিনরাত্রি? বন্দনাদের মুখ থুবড়ে থাকা ভিটে এখন জঙ্গলে ভরে গেছে। মণিকার লাগানো জবাগাছে এর মধ্যেই লাল জবা যেন জিব বের করে হাঁপাচ্ছে। ছোট্ট নীলিমা তার পুতুলের বিয়ে দেবে সেই ফুল দিয়ে। আমাকে বলে, এই ফুল সেখানেও দেবে— যেখানে বন্দনাদি ঘুমিয়ে আছে—কথা না রাখার পৃথিবী কি এভাবেই বাঁচে?
গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী এবং শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।