খরচের চাপে হিমশিম জীবন

Slider বিচিত্র

d3a9b5f07b01f919e78c7470c9f5cf27-59f31ec3514ec

 

 

 

 

মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। খরচ বেড়েছে জীবনযাপনের সব ক্ষেত্রেই। দফায় দফায় সরকার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানোয় সরাসরি এর প্রভাব পড়ছে পরিবারের ব্যয়ে। এ কারণে পণ্য উৎপাদন ও পরিবহন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে তাতেও। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন গড়পড়তা আয়ের মানুষেরা।
রাজধানী ঢাকার উত্তরায় দুই কক্ষের একটি বাসায় বসবাস করেন আবদুল্লাহ আল মামুন। এক সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর সংসারে সদস্যসংখ্যা তিনজন। স্বামী-স্ত্রী দুজন চাকরি করেও পরিবারের ব্যয় সামলাতে পারছেন না মামুন দম্পতি। তিনি বললেন, সব খাতেই ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু আয় সেভাবে বাড়ছে না। সংসার চালানোই এখন কষ্টকর হয়ে পড়ছে।
বাড়তি ব্যয় সামাল দিচ্ছেন কীভাবে—জবাবে মামুন বলেন, ‘আগে হয়তো মাছ-মাংস একটু বেশি কিনতাম। এখন কমিয়ে দিয়েছি। আগে যে পথ রিকশায় যেতাম, এখন সে পথ হেঁটে যাই।’
রাজধানীর বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে গত কয়েক দিন কথা বলে জানা যায়, একটি পরিবারে স্থির ব্যয় বেড়েছে মূলত বাসাভাড়া, সন্তানের শিক্ষার খরচ, পরিবহন ব্যয় এবং গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাবদ। কেব্‌ল টেলিভিশনের (ডিশ) সংযোগ ফি, গৃহকর্মীর মজুরি, এমনকি ময়লা ফেলার জন্যও বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে। মাসের শুরুতে বেতন পেয়েই এসব ব্যয় মেটাতে হয় পরিবারকে। এ ক্ষেত্রে সাশ্রয়ের কোনো সুযোগ নেই।
কাঁচাবাজারে মানুষের ব্যয়ও বেশ বেড়ে গেছে। চালের দাম এখন ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। বেশির ভাগ সবজি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৬০ টাকার বেশি দরে। কয়েক বছরে গরুর মাংসের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ভোজ্যতেলের দাম ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সময়ে সময়ে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, চিনি ইত্যাদির দাম বেড়ে বাজার খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমনকি লবণও ৪০ টাকা কেজিতে কিনে খেতে হচ্ছে দেশবাসীকে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৭১ শতাংশ। ক্যাবের এই হিসাব ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবার তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি। এতে শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রকৃত যাতায়াত ব্যয় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
ক্যাব বলছে, রাজধানীতে ২০০৯ সালে দুই শয়নকক্ষ বা বেডরুমের একটি পাকা বাসার গড় ভাড়া ছিল ১০ হাজার ৮০০ টাকা, ২০১৬ সালে তা ১৯ হাজার ৭০০ টাকায় উঠেছে। আলোচ্য সময়ে এক ইউনিট বিদ্যুতের দাম প্রায় ৯৩ শতাংশ, পানির দাম ৫৬ শতাংশ এবং প্রতি কিলোমিটার বাসভাড়া ৪৫ শতাংশ বেড়েছে।
বাজারে মানুষের কিছু স্থির ব্যয় কী রকম বেড়েছে, তা কয়েকটি পণ্যের দামেই ধারণা করা যায়। যেমন ২৩ টাকার মোটা চাল হয়েছে ৩৫ টাকা, যা সেপ্টেম্বর মাসে সাড়ে ৪৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছে ক্যাব। একটি সাবানের দাম ২০ টাকা থেকে বেড়ে ৪১ টাকায় উঠেছে। একটি জিয়া প্রিন্ট শাড়ি হয়েছে ৭০০ টাকা, যা ২০০৯ সালে ৩৮০ টাকা ছিল।
ব্যয় বাড়তে থাকায় ব্যয়বহুল নগরী হয়ে উঠছে ঢাকা। অন্যদিকে গ্রামীণ জীবনও কঠিন হয়ে উঠছে ব্যয় বৃদ্ধির চাপে। যুক্তরাজ্যের বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট-এর গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) গত মার্চে প্রকাশিত এক জরিপ অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল নগরীর তালিকায় শীর্ষ শহর এখন ঢাকা। ‘কস্ট অব লিভিং সার্ভে’ শীর্ষক এ জরিপ খাবার, পোশাক, বাড়িভাড়া, গৃহস্থালি পণ্য, প্রসাধন, পরিবহন, শিক্ষা, বিনোদন ব্যয়সহ ১৬০ ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা হয়। জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিক দিয়ে বিশ্বের মোট ১৩০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ৬২তম।

এখন সাশ্রয় কম
ব্যয় বৃদ্ধির চাপে দেশের মানুষ এখন আগের চেয়ে কম পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করতে পারছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, ২০১০ সালে দেশের একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা। বিপরীতে খরচ ছিল ১১ হাজার ২০০ টাকা। ফলে সাশ্রয় হতো ২৭৯ টাকা। ২০১৬ সালে একটি পরিবার সাশ্রয় করতে পারছে ২৩০ টাকা। আলোচ্য বছর একটি পরিবারের গড় আয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা এবং ব্যয় ১৫ হাজার ৭১৫ টাকায়।
গ্রামের মানুষ আছেন আরও বিপাকে। ২০১০ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে দেখা গিয়েছিল, তাঁদের গড় আয়ের পরিমাণ মোট ব্যয়ের চেয়ে বেশি। তাঁরা মাসে ৩৬ টাকা সাশ্রয় করতে পারতেন। ২০১৬ সালে দেখা যাচ্ছে তাঁদের মাসিক ব্যয় আয়ের চেয়ে ২৮৮ টাকা বেশি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, পরিস্থিতি প্রকাশের সবচেয়ে ভালো সূচক ভোক্তা মূল্যসূচক। আনুষ্ঠানিক হিসাব অনুযায়ী খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এতে বড় আঘাত আসে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। তিনি বলেন, দারিদ্র্যসীমার নিচের দিকে থাকা ২০ শতাংশ মানুষের দৈনিক খরচের ৪০ শতাংশ ব্যয় হয় চালের পেছনে। এ ক্ষেত্রে চালের মূল্য ১০ টাকা বৃদ্ধি মানে দরিদ্র মানুষের আয় ৪ টাকা কমে যাওয়া।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ে। এতে পণ্যের দাম বাড়ে কি না, সেটা গবেষণাসাপেক্ষ। তবে উৎপাদন খরচ বাড়লে এটা একসময় উৎপাদকেরা পণ্যের দামের ওপরই চাপান।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে সেপ্টেম্বর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। এ মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ, যা ৩৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

যেভাবে খরচ বেড়েছে
কাজীপাড়ার বাসিন্দা সাইমন কবির একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। দুই বছরে তাঁর বাসাভাড়া দুই হাজার টাকা বেড়েছে। বিদ্যুৎ বিল আগে আসত সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা, যা এখন ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত আসে। গ্যাসের বিল ৪৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০০ টাকা হয়েছে। বাড়িওয়ালা আগে পানির বিল নিতেন না, এখন পানি এবং ওঠানোর বিদ্যুৎ বিল বাবদ ৬০০ টাকা নিচ্ছেন। ডিশ সংযোগ বাবদ বিল বেড়েছে ১০০ টাকা। গৃহকর্মীর বেতন ৩০০ টাকা বাড়াতে হয়েছে।
এ হিসাবে দুই বছরে বাসায় সাইমন কবিরের স্থির ব্যয় বেড়েছে ৩ হাজার ৭৫০ টাকা। তিনি বলেন, বাজারে ব্যয়ও এখন অনেক বেশি। এখন এক বস্তা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ১ হাজার টাকা। গরুর মাংসের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কোনো ভালো মাছ কেজিপ্রতি ৫০০ টাকার নিচে মেলে না। ৬০ টাকা কেজির নিচে এখন সবজি পাওয়া যায় না।
সাইমন কবির বলেন, এখন আর লোডশেডিং নেই। অ্যাপার্টমেন্টে জেনারেটর চালানো দরকার হয় না। কিন্তু ফ্ল্যাট মালিকেরা সার্ভিস চার্জ কমাননি। ৪ হাজার টাকাই নেন।
আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা সায়মা সুলতানা একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। সকালে তাঁকে মতিঝিল যেতে হয় অটোরিকশায় করে। তিনি বলেন, সকালে আগারগাঁও থেকে কোনো বাসে ওঠা যায় না। এতে তাঁকে ৩০০ টাকা ভাড়া দিয়ে যেতে হয়। মেয়েকে ৫ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রাইভেট টিউশন দিতে হয়। তিনি বলেন, ‘রাজধানীতে যদি ভালো বাস চলত, তাহলে আমাকে অটোরিকশায় ৩০০ টাকা দিয়ে যেতে হতো না। বিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা ভালো করে পড়ালে প্রাইভেট টিউশন দিতে হতো না। এভাবে অব্যবস্থাপনায়ও সংসারের ওপর চাপ বাড়ে।’
ক্যাবের জীবনযাত্রার ব্যয়ের হিসাব তৈরি করেন সংগঠনটির কর্মসূচি সমন্বয়কারী আহম্মেদ একরামুল্লাহ। নিজের জীবনযাত্রার ব্যয় কীভাবে বেড়েছে—জানতে চাইলে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, বাসাভাড়া, বাজারসহ বিভিন্ন খাতের হিসাব তুলে ধরেন, যা অন্যদের মতোই। তিনি বলেন, গোপীবাগ থেকে সেগুনবাগিচায় ক্যাবের কার্যালয়ে যাওয়ার রিকশাভাড়া ছিল ৪০ টাকা। এখন এ পথটুকু ৬০ টাকায়ও যেতে চান না রিকশা চালকেরা।

খরচ কমানোর যত উপায়
সংসারের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সীমিত আয়ের পরিবারগুলো এখন নানাভাবে খরচ কমানোর চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে অবলম্বন করছে বিচিত্র সব উপায়। রিকশার পথ হেঁটে যাওয়া, বাজারে কম দামি মাছ ও সবজি কেনা, বিয়েসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়া, কম দামি সিগারেট কেনা, সন্তানকে প্রাইভেট টিউশন দেওয়ার বদলে নিজেই পড়ানোসহ বিভিন্ন উপায়ের কথা জানা গেছে মানুষের সঙ্গে কথা বলে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মিরাজ আহমেদ, যে প্রতিষ্ঠানে গত দুই বছরে কারও বেতন বাড়েনি। খরচ কমানোর উপায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ধরেন, স্ত্রীকে নিয়ে মাসে দু-একবার রেস্তোরাঁয় খেতে যেতাম। এখন সেটা বাদ দিয়েছি।’
কারওয়ান বাজারে একটি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক শফিউল ইসলাম খরচ কমাতে বাসায় যান সাইকেল চালিয়ে। তিনি বলেন, মিরপুর ১ নম্বর সেকশন থেকে কারওয়ান বাজার যেতে তাঁর ৪৫ মিনিটের মতো লাগে। এতে যানজটে পড়তে হয় না, খরচও মাসে দেড় হাজার টাকা কমেছে।
সামগ্রিক বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম বলেন, মূল্যস্ফীতিতে খাদ্যের ভূমিকা বেশি। খাদ্যের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়ে; বিশেষ করে চাল। আর সম্প্রতি চাল ও সবজির মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বেড়েছে। আবার নতুন করে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে সেটা পরিবারের ব্যয় আরও বাড়াবে। পাশাপাশি তা উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে পণ্য ও সেবার দাম বাড়াবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *