দলের জেলা, মহানগর ও উপজেলা কাউন্সিলে পুরনো এবং ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। কাউন্সিলে যেন নতুন সংসদ সদস্যরা কর্তৃত্ব করতে না পারেন সে বিষয়টিও কঠোরভাবে দেখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া কমিটিগুলোতে তাঁরা যাতে পদ না পান সে বিষয়েও তিনি কাউন্সিল সম্পন্ন করার লক্ষ্যে গঠিত ১০টি টিমের নেতাদের সতর্ক থাকতে বলেছেন।
গতকাল শুক্রবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে শেখ হাসিনা এসব নির্দেশনা দেন। বৈঠকে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা দলীয় প্রধানকে জানান, দলের অনেক নেতা কয়েক বছর রাজনীতি করে সংসদ সদস্য হয়েছেন। তাঁরা এখন আবার জেলা-উপজেলার নেতৃত্ব দখলের চেষ্টা করছেন। তাঁদের কারণে পুরনো ও ত্যাগী নেতারা বাদ পড়ে যাচ্ছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি উল্লিখিত নির্দেশনা দেন।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় কমিটি গঠন নিয়ে মতপার্থক্য ঠাণ্ডা মাথায় সামাল দিতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে দলীয় কোন্দল প্রকাশ্যে আসা ও পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠনের মতো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা নেতাদের বলেন, কোনো জায়গায় খুব বেশি জটিলতা বা বড় ধরনের সমস্যা তৈরির আশঙ্কা দেখলে সেখানে কমিটি ঘোষণা থেকে বিরত থাকবেন। ঢাকায় এসে আমার সঙ্গে কথা বলে কমিটি ঘোষণা দেবেন।
কয়লা আমদানির পরামর্শ : গতকাল বৈঠকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ইটভাটায় কয়লা সংকটের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনেন। তিনি জানান, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি পানির কারণে প্রায় তিন মাস বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে ভারত নীতিগত কারণে বাংলাদেশে কয়লা রপ্তানি করে না। ফলে ইটভাটার মালিকরা বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছেন। বিপুর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদেশ থেকে কয়লা আমদানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। এ ক্ষেত্রে ইটভাটার মালিকদের অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আমদানির নির্দেশ দিতে বলেন শেখ হাসিনা।
ক্ষোভের মুখে পড়লেন নাসিম ও সুভাষ বোস : বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং নড়াইলের সাবেক সংসদ সদস্য সুভাষ চন্দ্র বোস ক্ষোভের মুখে পড়েন। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উদ্যাপনে একটি জাতীয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তোপের মুখে পড়েন মোহাম্মদ নাসিম। গত বছর এ ধরনের একটি কমিটি গঠন করে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘কমিটি করবেন, মঞ্চ বানাবেন, মঞ্চে অনেকে মিলে বসে থাকবেন, এটা হবে না।’
নড়াইলে ওয়ার্কার্স পার্টির সংসদ সদস্য শেখ হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেন সুভাষ চন্দ্র বোস। এ সময় সুভাষ বোসকে উদ্দেশ করে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘ফালতু বিষয় নিয়ে বৈঠকে কথা বলেন কেন? গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টি আমাদের পাশে থেকেছে। ঐক্যের খাতিরে আমরা যেখানে যাকে যোগ্য মনে করেছি মনোনয়ন দিয়েছি। বৃহৎ জাতীয় ঐক্য গড়ার জন্য আমাদের কাজ করা উচিত।’
তত্ত্বাবধায়ক থিওরি ডুবে গেছে : এর আগে বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে শেখ হাসিনা সুধীসমাজের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আকাশে-বাতাসে, পত্রিকার পাতায় দেশের উন্নয়নে অনেকের অনেক থিওরি (তত্ত্ব) শুনি। কিন্তু ওনাদের দেওয়া তত্ত্বাবধায়ক থিওরি ডুবে গেছে। আমি অতশত থিওরি বুঝি না। আমি একটাই থিওরি বুঝি যে, কিভাবে সব মানুষের অন্ন, চিকিৎসা, বাসস্থান ও উন্নত জীবন নিশ্চিত করব। এই থিওরি নিয়ে আমি দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। দেশ আজ সব দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। কেউ এই অগ্রযাত্রা রুখতে পারবে না।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যাঁরা ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি, লুটপাট, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে মানুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলেছেন, এতিমের টাকা পর্যন্ত মেরে খেয়েছেন, তাঁদের গলায় এখন বড় আওয়াজ শুনি। আর তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হলেই আমাদের দোষ। উনি যদি এতিমের টাকা মেরে না-ই খাবেন, তবে আদালত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন? সাহস থাকলে মামলা মোকাবিলা করে প্রমাণ করুন, আপনি এতিমের টাকা মেরে খাননি।’
বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক, বিশ্বব্যাংক আমাদের দুর্নীতি খুঁজে পায়নি : প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি আমাদের দুর্নীতি তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। আমার বিরুদ্ধে ১০-১২টি মিথ্যা মামলা দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেও আমাদের দুর্নীতি খুঁজেছে, তারাও আমার বিরুদ্ধে চার-পাঁচটি মিথ্যা মামলা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকও দুর্নীতির অজুহাত তুলে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে পরে তন্নতন্ন করে খুঁজেও দুর্নীতির অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক ও বিশ্বব্যাংক আমাদের দুর্নীতি খুঁজে পায়নি। কিন্তু যারা আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিল, দুর্নীতি করে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছে, বিদেশে পাচার করেছে, সেই বিএনপির নেত্রী এখন আমাদের দুর্নীতি খুঁজে বেড়ান।’
সারা দেশে কাউন্সিলের মাধ্যমে দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার কার্যক্রমের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, সারা দেশে ওয়ার্ড, থানা, উপজেলা ও জেলার সম্মেলন চলছে। অনেক জেলার সম্মেলন ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। সব সহযোগী সংগঠনেরও সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছে। আর এ সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব গঠন প্রক্রিয়ায় মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছে।
শেখ হাসিনার সূচনা বক্তব্যের পর তাঁর সভাপতিত্বে সভায় শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এরপর বক্তব্য দেন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
বৈঠকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছাড়াও আগামী ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু দিবস, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, ১৬ ডিসেম্বর মহান বুদ্ধিজীবী দিবস এবং ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের লক্ষ্যে দলীয় কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হয়।