রাজধানীর উত্তরাংশে বিস্তীর্ণ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে একদিকে চলছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার নতুন খাল খনন প্রকল্প, অন্যদিকে একই এলাকার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া বোয়ালিয়া খালের একটি অংশ ভরাট করে আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের সমিতির বিরুদ্ধে।
খিলক্ষেত এলাকায় পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য এই আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি। কিন্তু ‘জলাধার আইন লঙ্ঘনের’ অভিযোগ এনে খালটি ভরাট না করার জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) গত এপ্রিলে সমিতিকে চিঠি দেয়। এখন পর্যন্ত খালের ভরাট হওয়া অংশ পুনরুদ্ধারে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান।
তবে পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, খাল ভরাটের অভিযোগের বিষয়টি নিছকই ‘অপপ্রচার’। প্রকল্পের জন্য খালের যে অংশটুকু ভরাট করা হয়েছে, তা তাদের কিনে নেওয়া। এতে আইন লঙ্ঘন করা হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কুড়িল–পূর্বাচল ১০০ ফুট নতুন যে খাল খনন করা হচ্ছে, তা যদি বোয়ালিয়া খালের সঙ্গে সংযুক্ত করা না যায় এবং বোয়ালিয়া খালের প্রবাহ ঠিক রাখা না গেলে পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রকল্পের এ খাল উপচে দুই পাড় প্লাবিত হবে।
স্থানীয় বাসিন্দা, রাজউকের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বোয়ালিয়া খাল ভরাট করায় এখনই দক্ষিণখান, খিলক্ষেত, কাওলা, গুলশান,
বারিধারা, সেনানিবাস, নিকুঞ্জ, জোয়ার সাহারাসহ বিস্তীর্ণ এলাকা জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে।
বোয়ালিয়া খালের উৎপত্তি উত্তরখান থানার তেমুখ এলাকার তুরাগ নদ থেকে। সেখান থেকে খালটি পোড়াদিয়া, ভাটারা ও বরুয়ার ভেতর দিয়ে বেরাইদের কাছে বালু নদে মিশেছে। একসময় খালটি তেমুখ থেকে বেরাইদ পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ছিল। এখন তেমুখ থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা পর্যন্ত প্রায় ৮ কিলোমিটার এবং বসুন্ধরার এম ব্লক থেকে বালু নদ পর্যন্ত সাড়ে তিন কিলোমিটারের মতো খাল আছে। মাঝের দেড় কিলোমিটার অংশ ভরাট করে ফেলা হয়েছে। রাজউক এই তথ্য দিলেও খালের জন্য কেবল চিঠি দিয়েই কর্তব্য সেরেছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়কের বোয়ালিয়া সেতুর নিচে খালের প্রশস্ততা দেড় শ ফুটের মতো। এর উত্তরে খিলক্ষেত-ইছাপুরা সড়কের ওপর পুরোনো বোয়ালিয়া সেতুর কাছে প্রশস্ততা প্রায় ২০০ ফুট। সেখানে দুজন ব্যক্তি খালে জাল ফেলে মাছ ধরছেন। কিন্তু পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটির ৩০০ মিটার অংশে খালটি প্রস্থে কোথাও ৩০ ফুট, কোথাও ৪০ ফুটের মতো।
খালের এই অংশ ভরাটের বিষয়টি রাজউক কর্মকর্তাদের নজরে আসে ‘১০০ ফুট খাল খনন ও উন্নয়ন প্রকল্প’ এলাকা পরিদর্শনের সময়। নগর-পরিকল্পনা শাখা থেকে দ্বিতীয় দফা পরিদর্শন ও জরিপে খাল ভরাটের প্রমাণ পান রাজউকের কর্মকর্তারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম গত ১৭ এপ্রিল পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) ও পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির দপ্তর সম্পাদক গাজী মো. মোজাম্মেল হককে চিঠি দেন। চিঠিতে বলা হয়, ‘সরেজমিনে জরিপে দেখা গেছে, কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডে সংলগ্ন “পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি” আবাসন প্রকল্প এলাকার অভ্যন্তরে বোয়ালিয়া খাল আপনার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ভরাট করা হয়েছে, যা জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০-এর পরিপন্থী।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘উক্ত এলাকাসহ খিলক্ষেত, লেকসিটি কনকর্ড এবং তৎসংলগ্ন পার্শ্ববর্তী এলাকার বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনের জন্য বোয়ালিয়া খালের নিরবচ্ছিন্ন পানিপ্রবাহ অতীব জরুরি।’ এ অবস্থায় পুলিশের প্রকল্প এলাকার ভেতরে ‘প্রবহমান’ বোয়ালিয়া খাল ‘ভরাট বন্ধে’ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।
এ বিষয়ে নতুন ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, বোয়ালিয়া খালের প্রশস্ততা এখনো কোথাও কোথাও বালু নদের চেয়ে বেশি। এমন একটি খালের প্রবাহ বন্ধ করা কোনোভাবেই উচিত না। বরং খননের মাধ্যমে খালটির নাব্যতা ফিরিয়ে এনে খালটি সংরক্ষণের এখনই সেরা সময়। আশপাশে তেমন নগরায়ণ না হওয়ার কারণে ব্যয়ও কম হবে।
পূর্বাচলে ১০০ ফুট খাল খননের জন্য অধিগ্রহণ করা জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান অনুষ্ঠানে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘আমরা জানি কে বা কারা এই দখলের সঙ্গে যুক্ত। এই দখলদারদের উচ্ছেদ করে প্রয়োজনে ব্যয় বাড়িয়ে ১০০ ফুট খাল খনন প্রকল্পের আওতায় বোয়ালিয়া খাল ড্রেজিং করতে হবে।’
১০০ ফুট খাল খনন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলামও বোয়ালিয়া খাল ভরাট প্রশ্নে নিজের উদ্বেগের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘ঢাকার একটি বড় অংশের বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনের জন্য আমরা রাস্তা কেটে খাল বানাচ্ছি। আর তারা আস্ত একটা খালই ভরাট করে ফেলছে।’ তিনি আরও বলেন, ১০০ ফুট খালটি প্রথমে বোয়ালিয়া খালের সঙ্গে মিলবে। পরে তা বালু নদ পর্যন্ত যাবে। এ ক্ষেত্রে বোয়ালিয়া খালের প্রবাহই যদি ঠিক না থাকে, তাহলে এই প্রকল্প কোনো কাজে আসবে না।
পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির দপ্তর সম্পাদক গাজী মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ড্যাপে প্রকল্প এলাকার ভেতর দিয়ে যাওয়া খালটির প্রশস্ততা দেড় শ ফুট দেখানো হলেও সিএস ও আরএস জরিপে তা কোথাও ৩০ ফুট, কোথাও ৪০ ফুট। যে নকশায় জমিটি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, সে অনুসারেই খালটি রাখা হয়েছে। বাড়তি অংশ ভরাটের প্রশ্নই আসে না।’
এ বিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, ‘খাল ভরাটের বিষয়টি তো তারা স্বীকারই করছে না। এর প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য এখন আমরা আমাদের মতো ব্যবস্থা নেব। জেলা প্রশাসন ও জরিপ অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলে এ জন্য যা যা করণীয়, তা করা হবে। এ ব্যাপারে গণপূর্তমন্ত্রীরও কঠোর নির্দেশনা আছে।’