এলিয়েন বা ভিনগ্রহের জীবদের নিয়ে মানুষের আগ্রহ চিরন্তন। এই বিপুল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমরাই আছি শুধু—এটা মন মানতে চায় না। অশেষ এই মহাবিশ্বের অন্য কোথাও কি নেই প্রাণের অস্তিত্ব?
পৃথিবী নামক বালুকণায় বসে আমরা কল্পনা করি, অন্য কোথাও আছে ভিনগ্রহের জীবেরা। এই কল্পনা সবচেয়ে বেশি জমে ওঠে সিনেমার ভাষায়। ১৯৫১ সালের দ্য ডে দ্য আর্থ স্টুড স্টিল থেকে হালের দ্য অ্যারাইভাল-এর মতো বহু ছবিতে আমরা তাই দেখি এসব এলিয়েন বা রহস্যময় আগন্তুকের উপস্থিতি। ইটির মতো মজাদার চরিত্রের হতে পারে তা, অথবা হতে পারে এলিয়েন সিরিজের মতো ভয়ংকর কিছু। রহস্যময় আগন্তুক নিয়ে সিনেমা ছাড়াও আরও নানা ধরনের সৃষ্টিকর্ম রয়েছে মানুষের। কিন্তু বাস্তবে এমন কিছুর সন্ধান কেউ পায়নি। কোনো দেশে পাওয়া যায়নি।
তবে আমার ধারণা, ভিনগ্রহের জীব বা আগন্তুক ধরনের কিছু একটা সত্যি আছে আমাদের দেশে। আছে মহাকাশযান, আগন্তুকের রহস্যময়তা। হঠাৎ করে কোথা থেকে উদয় হয় তারা, হঠাৎ হয় উধাও। ছোঁ মেরে সঙ্গে নিয়ে যায় বাংলাদেশের হকচকিত কিছু মানুষকে। এলিয়েন বা রহস্যময় আগন্তুক বলেই হয়তো তাদের আর কোথাও খুঁজে পায় না পুলিশ, গোয়েন্দা, আমজনতা।
প্রধান বিচারপতি, নির্বাচন, রোহিঙ্গা—এসব ইস্যুর জটিলতায় এখন মগ্ন আমরা। কিন্তু এতে থেমে নেই রহস্যময় আগন্তুক সমাজ, থেমে নেই তাদের নিয়ে আতঙ্কও। মাত্র কয়েক দিন আগেও রাস্তা থেকে উধাও হয়েছেন একাধিক ব্যক্তি। তাদের বিষয়টি তাই কখনো এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয় কারও।
২.
বাংলাদেশে এই রহস্যময় আগন্তুকেরা এসেছে হয়তো বহু আগে। কিন্তু ঘন ঘন এই এলাকায় তাদের হানা দেওয়া শুরু হয়েছে কয়েক বছর ধরে। আট বছরে কয়েক শ মানুষ তাদের খপ্পরে পড়েছে, এর মধ্যে এ বছর প্রথম ছয় মাসেই অর্ধশতাধিক মানুষ! আগে তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পছন্দের মানুষকে তুলে নিয়ে উধাও হতো। এখন তাদের মধ্যে বেড়েছে রোমাঞ্চপ্রিয়তা, বেড়েছে মাফিয়া স্টাইলে রাস্তা থেকে তুলে নেওয়ার প্রবণতা। তাদের মহাকাশযান তাই হঠাৎ হঠাৎ ঘাপটি মেরে থাকে ব্যস্ত কোনো সড়কে। সেখান থেকে ঝটপট তারা বের হয়ে আসে। অফিসযাত্রী, হোটেলযাত্রী, বাড়িমুখী—যেকোনো পছন্দের মানুষকে নিমেষে তুলে নেয় তাদের যানের ভেতর। তারপর তা যেন উধাও হয়ে যায় মহাবিশ্বের দূরতম কোনো অঞ্চলে। আর কখনো খোঁজ মেলে না তাদের বা তাদের গাড়ির।
রহস্যময় আগন্তুকেরা যাদের তুলে নিয়ে যায়, সেসব পরিবারে কান্নার রোল ওঠে। বছরের পর বছর বুক চাপড়ে কাঁদে নিখোঁজ মানুষের পিতা-মাতা, পরিবার, শিশুসন্তান। কিন্তু নিখোঁজ মানুষের আর খোঁজ মেলে না। কালেভদ্রে তাদের দু-একজনকে এসব আগন্তুক ফেরত দেয় জীবিত বা মৃত অবস্থায়, কালেভদ্রে দু-একজনকে তারা ধরে নিয়ে ছেড়ে দেয় পাশের দেশে। জীবিত যারা ফেরত আসে, তারা আর মনে করতে পারে না কিছু। তরুণ পারে না, বৃদ্ধ পারে না, ব্যবসায়ী পারে না, কবি পারে না। জীবন ও জগতের সবকিছু তারা মনে করতে পারে। শুধু মনে করতে পারে না ধরা পড়া আর ছাড়া পাওয়ার মাঝখানের সময়টুকু।
এসব রহস্যময় আগন্তুক দেখে অবশ্য দৃষ্টিবিভ্রম ঘটে আশপাশে থাকা মানুষের। তাঁরা দেখেন, এই রহস্যময় অপহরণকারীরা দেখতে মানুষের মতো, তাদের মহাকাশযান মানুষের মাইক্রোবাসের মতো। মানুষের মতো করে তারা হুংকার দেয়, হাতকড়া পরায়, ধস্তাধস্তি করে, ঠেলেঠুলে কোনো মানুষকে ঢোকায় মাইক্রোবাসে। মানুষের গাড়ির মতোই তাদের গাড়ি ছুটে যায় রাজপথ কামড়ে। কিন্তু তারপর হঠাৎ তা উধাও হয় সবকিছু থেকে। সিসিটিভি, ট্রাফিক পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, র্যাবের গাড়ি, নিরাপত্তা এলাকার শ্যেনদৃষ্টি—কোনো কিছুর চোখে পড়ে না আর তা।
তাদের সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী মানুষের এই বর্ণনা অবিশ্বাস্য ও অগ্রহণযোগ্য। তাই তা আমলে নেয় না পুলিশ। বেশি মানুষ এটা নিয়ে শোরগোল তুললে তারা একটা জিডি করে মাঝেমধ্যে। কিন্তু নিখোঁজ হওয়া মানুষের খোঁজ আর কখনো পায় না তারা। না পায় তার ঠিকানা, না পায় তার লাশ। কারণ, তারা জানে, এটা রহস্যময় আগন্তুকদের কাজ।
এদের খোঁজার মতো প্রযুক্তি, সাহস বা সিদ্ধান্ত নেই পুলিশের। এটি তারা অবশ্য স্বীকার করে না আমজনতার কাছে। তারা দাবি করে, এগুলো নিখোঁজ মানুষের স্বজনদের বানানো গল্প। পাওনাদার, স্ত্রী কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে কিছু মানুষ নিজেরাই লুকিয়ে থেকে ঝামেলা পাকায়। কিংবা নিজেরাই কাউকে দিয়ে নিজেকে নিখোঁজ করিয়ে সৃষ্টি করে কাঁচা নাটক।
এসব নাটক বা বানানো গল্প বিশ্বাস করার সময় নেই পুলিশের। প্রটোকল প্রদান, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, নাশকতা দমনসহ নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় তাদের। রহস্যময় আগন্তুকেরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
৩.
রহস্যময় এই আগন্তুকেরা নিজেরাও সরকারপন্থী। সরকারের কেউ তাই তাদের খপ্পরে পড়ে না। পড়ে কেবল বিরোধী মতের মানুষ। হয়তো সরকারের উন্নয়ন, নতুন ঘরানার নির্বাচন, তথ্যপ্রযুক্তির কারিশমায় মুগ্ধ তারা। বিরক্ত এসবে বাধা দেওয়া বা সমঝদার হতে ব্যর্থ হওয়া মানুষের প্রতি। তাই তাদের টার্গেট থাকে প্রধানত বিরোধী দল বা ভিন্নমতের মানুষ। বিরোধী দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে তাই উধাও করে দেওয়ার নেশায় বেশি মেতে ওঠে এরা।
অনেক সময় নানা অজ্ঞাত কারণেও তাদের তৎপর হতে দেখা যায়। গত সেপ্টেম্বর মাসে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মাত্র এক সপ্তাহে এই শহর থেকে তারা লোপাট করে দেয় দুই ব্যবসায়ী ও এক ব্যাংক কর্মকর্তাকে। ধূর্ত এই এলিয়েনরা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে নিজেদের পরিচয় দেয় গোয়েন্দা সংস্থার লোক হিসেবে।
তাদের আরও বৈশিষ্ট্য আছে। এরা পুরুষবিদ্বেষী। সব ক্ষেত্রে তাই তারা শুধু তুলে নেয় পুরুষদের, বিশেষ করে তরতাজা ধরনের পুরুষদের। কোনো কোনো নারীর আহাজারিতে বিষাদময় হয়ে তারা কোনো কোনো পুরুষকে ফেরত দিয়েছে বটে। কিন্তু ভিনগ্রহের এই জীবদের রাজ্য থেকে ফিরে তারা আর পুরুষ হয়ে থাকেনি। অজানা ভয়ে কাপুরুষের মতো নির্বাক হয়ে আছে এরা বাকি জীবন।
রহস্যময় এই আগন্তুকদের কোনো পদচিহ্ন নেই, অপরাধের আলামত নেই, তাদের জন্য দেশে কোনো আইন নেই। ধরার জন্য কোনো বিশেষ বাহিনী নেই, কোনো আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত বা অন্য কোনো মত বা ইচ্ছে নেই। তাদের সঙ্গে অবশ্য একশ্রেণির পুলিশের রয়েছে দুর্বোধ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিছু ঘটনায় দেখা গেছে, পুলিশ যাকে গ্রেপ্তার করেছে, তাকে রহস্যময় আগন্তুকেরা তুলে নিয়ে উধাও করে দিয়েছে। সাতক্ষীরায় সদ্য সন্তান জন্ম দেওয়া জেসমিন তঁার স্বামীকে থানায় তিন দিন ভাত খাইয়ে দিয়ে এসেছিলেন। পরের দিন থেকে দেখেন থানা থেকে উধাও তাঁর স্বামী। পুলিশ অবশ্য স্বীকার করেনি এটি। আগন্তুক-ভীতি কমাতে জনস্বার্থে এমন করতে হয় পুলিশকে।
উল্টো ঘটনাও ঘটে কখনো কখনো। গায়েব করা মানুষকে পরে দেখা যায় পুলিশের হাজতে। তাদের রোষ এড়াতে এ নিয়ে কোনো কৃতিত্ব জাহির করে না পুলিশ। এসব নিয়ে আজকাল বেশি প্রশ্নও করে না বাংলাদেশের বিজ্ঞ সমাজ। প্রশ্ন তুলতে ইচ্ছুক মানুষের ওপর রহস্যময় আগন্তুকদের বিশেষ নজরদারি রয়েছে বলে খবর আছে তাদের কাছে।
৪.
রহস্যময় আগন্তুকদের সমস্যা একটাই। এ দেশের ও বিদেশের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ করে মানবাধিকার নামে একটা ফালতু বিষয় নিয়ে। এরা মানুষ আর আগন্তুকদের পার্থক্য বোঝে না। মানুষের ক্যামেরা, মানুষের যান আর মানুষের বাহিনী দিয়ে গ্রেপ্তারের দাবি তোলে তাদের। মানুষের আইন-আদালতে বিচার করার দাবি তোলে এরা অশরীরী আগন্তুকদের। তারা ব্যাপক উদারতা দেখিয়ে সহ্য করে এসব মানবীয় মূর্খতাকে। কিন্তু কখনো অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে এরা তুলে নেয় মানবাধিকারের লোকজনকেও।
তাদের আরেকটা সমস্যা আছে। তা হচ্ছে, বহু কিছুর মতো এ দেশে শুরু হয়েছে আগন্তুক-বাণিজ্যও। রহস্যময় আগন্তুকদের ভয় দেখিয়ে বা আগন্তুক সেজে উধাও করার এসব বাণিজ্যে আগন্তুক সমাজের কৌলীন্য হোঁচট খাচ্ছে আজকাল।
এ দেশের আদালত এই বাণিজ্য বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। এ জন্য গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির স্বজনকে ফোন করে তাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা জানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই আদেশ অবশ্য তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এই সুযোগে আগন্তুক সেজে আদালতকে অগ্রাহ্য করে চলেছে আগন্তুক বণিকেরাও।
রহস্যময় আগন্তুক-আতঙ্কে তাই দিশেহারা বাংলাদেশের মানুষ। তারা জানে না এদের থেকে বাঁচার উপায়। একমাত্র বিরোধী দল জানে এটা। তারা জানে ভবিষ্যতেÿ ক্ষমতায় যেতে পারলেই বেঁচে যাবে তারা। সেটি হলেই কেবল রহস্যময় আগন্তুকদের খপ্পরে আর পড়বে না তারা। কারণ, রহস্যময় আগন্তুক মানেই সরকারপন্থী।
আমরা আমজনতা। আমরা ভাবি, আজব এই রহস্যময় আগন্তুক কবে হবে আমজনতাপন্থী!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।