‘এক রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার: যে নারীর শিশুসন্তানকে আগুনে ছুড়ে ফেলা হয়েছে, তাঁকে কী বলবেন?’ শিরোনামে সাংবাদিক জেফরি জেটলম্যানের এই লেখাটি ১৯ অক্টোবর নিউইয়র্ক টাইমসের অনলাইনে প্রকাশিত হয় ..
সবে বেরিয়েছি শরণার্থী শিবির থেকে। ফোনটা বেজে উঠল। অপর প্রান্তে আমার স্ত্রী। হ্যালো বলতেই আমার গলার অস্বাভাবিকতা ও আঁচ করতে পেরেছিল।
‘কী হয়েছে তোমার? কোনো সমস্যা?’ বললাম, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে সাক্ষাৎকারটা শেষ করলাম এই মাত্র।’
আমি তখন মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে দাঁড়িয়ে। এই সীমান্ত দিয়েই প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। সম্ভবত এই রোহিঙ্গারাই বিশ্বের সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত নৃগোষ্ঠী। মিয়ানমার সরকার নির্বিচারে নরহত্যা শুরু করলে তাঁরা প্রাণ নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। তাঁদেরই একজন রাজুমা। অল্পবয়স্ক এই নারীর সঙ্গে কথা বলে আমি বিদায় নিলাম। লাল রঙের ঘোমটা দেওয়া শীর্ণকায়া সেই নারী আমার জীবনের সবচেয়ে ভীতি-জাগানিয়া গল্প বলে চোখের নিমেষে মিলিয়ে গেলেন জনস্রোতে।
আমি সুদানের গণহত্যার সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়েছি, ইরাকে শিশুদের বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া নিয়ে লিখেছি। আমি ভূমিকম্প, হারিকেন, গৃহযুদ্ধ, দেশে দেশে যুদ্ধ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, দুর্ভিক্ষ নিয়ে কাজ করেছি। আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা হিসেবে এটাই আমার কাজ। দুই দশকের এই অভিজ্ঞতা আমাকে এখন হতাশাবাদ-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বানিয়েছে। কিন্তু রাজুমার গল্প আমাকে স্তব্ধ করে দিল।
রাজুমা যখন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করলেন, দেখলাম সে গল্প আর সব রোহিঙ্গা শরণার্থীর জীবনে ঘটে যাওয়া গল্পের মতোই। মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা গত আগস্টে গ্রামে ঢুকেছিল, তারপর একটি একটি করে গ্রাম জ্বালিয়ে দিল। তারা নারী ও পুরুষকে আলাদা করল। তারপর পুরুষদের হত্যা করল আর নারীদের ধর্ষণ।কিন্তু রাজুমাকে ধর্ষণের আগে সৈন্যরা ওর কোলের ছেলেটাকে টেনেহিঁচড়ে ছিনিয়ে নিয়ে আগুনে ছুড়ে ফেলেছিল। আগুনে পুড়তে পুড়তে একটিবার মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য চিৎকার করে কাঁদছিল সে।
আমরা একটা ঝুপড়ির সামনে একসঙ্গে বসেছিলাম। আমাদের সঙ্গে ছিলেন একজন অনুবাদকও। আমরা সবাই ছোট্ট টুলের ওপর ঝুঁকে বসা। একসময় রাজুমা ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি কপাল কুঁচকালাম। আমার নিজের ওপরই রাগ হতে লাগল।
‘আচ্ছা, আমি কেন আবারও এই মানুষটাকে তাঁর দুর্বিষহ স্মৃতির মধ্যে ঠেলে দিলাম? এত ভয়ংকর ঘটনা কি কেউ পড়তে চাইবে? এমনকি আমি নিজেই তো এটা লিখব না।’
আমার মনে হয়, আমি অনুভূতিশূন্যতার উল্টো যে অনুভূতি, তাতে আচ্ছন্ন হচ্ছি। একটা করে বিপর্যয়ের সংবাদ সংগ্রহ করি, একটা করে হারানোর ক্ষত সয়ে নিই; আর মনে হয় পৃথিবীর সব অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য মনের মধ্যকার যে বর্মটি, তা ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর এই ঘটনাগুলোর সংবাদ সংগ্রহ করতে করতে এখন মনে হয়, ভেতরকার সেই বর্মটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখন যখন আমি এ ধরনের অ্যাসাইনমেন্টে যাই, অস্থিরতা-উদ্বেগ আমাকে কুরে কুরে খায়।
এমনকি রাজুমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেও আমি ভেঙেচুরে যাচ্ছিলাম। শরণার্থী শিবিরের প্রথম দিনে শুধু এক প্যাকেট গ্লুকোজ বিস্কুটের জন্য পশুর মতো গাদাগাদি করে রাখা রোহিঙ্গা পুরুষদের সম্মানটুকু নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করতে দেখেছি। ওই দৃশ্য সহ্য করা যায় না।
আমি খুব কষ্ট পেলাম, কিন্তু পরে জানতে পারলাম, দশকের পর দশক রোহিঙ্গারা শিকারের লক্ষ্যবস্তু হয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে। নাজিদের জার্মানিতে ইহুদিদের মতো তারাও বলির পাঁঠা। রুয়ান্ডার গণহত্যার সময় তুতসিদের যেমন কীটপতঙ্গ বলা হতো, রোহিঙ্গাদেরও তা-ই বলা হচ্ছে। তারা বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মুসলিম, তাদের সরকারই মানবিক অধিকারটুকু কেড়ে নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সহজ শিকারে পরিণত করেছে।
তাই আমি ভাবতে শুরু করলাম। যদি এই সংবাদ আমরা সংগ্রহ না করি, তার ফল হতে পারে আরও খারাপ। এটা তাদের প্রতি নতুন করে আরেকটা অন্যায়ের নামান্তর। রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের প্রতি আরও অপমান। না লেখা মানে রাজুমাকে বোঝানো, আসলে তিনি যা সয়েছেন, তা নিয়ে বিশ্ব এতটুকুও বিচলিত নয়।
সাক্ষাৎকারটা শেষ করতে বেগ পেতে হচ্ছিল। কথাবার্তা যখন শেষের পথে, তখন আমার মনের মধ্যে একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খায়। আচ্ছা, যাওয়ার সময় আমি ওকে কী বলব? আমাদের সংস্কৃতিতে হয়তো আমরা বলতাম, ‘আপনি কাউকে দেখিয়ে নেবেন।’ কিন্তু ওখানে কোনো মনোচিকিৎসক নেই। আমি জানতাম, কথা শেষে রাজুমা সেই বাঁশের ওপর প্লাস্টিকের ত্রিপল-ঘেরা ঝুপড়িতে ফিরে যাবেন। তারপর সেই মুহূর্তগুলোর কথা আবার ভাবতে বসবেন, বারবার ভাববেন, যে মুহূর্তগুলোর কথা আমিই তাঁকে মনে করতে বলেছিলাম।
আমার ইচ্ছা হয়েছিল পকেটে থাকা প্রতিটি ডলার তাঁকে দিয়ে দিই। অথবা তাঁকে আলিঙ্গন করি। কিংবা কারও মুখের ওপর প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুষি বসিয়ে দিই। সাংবাদিক-জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় হলো আসলে এটাই, যখন অসহায় বোধ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। শুধু যে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ঘটনাগুলো দেখে যেতে হয় তা-ই নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এত কিছু ঘটে, সেখানে এত কিছু করার থাকে! আমরা তথ্য সংগ্রহ করি, আমরা নিজের চোখে সব ঘটতে দেখি, কিন্তু আমরা ত্রাণকর্মী নই। যদি রাজুমা আমরা সামনে কেটে-ছিঁড়ে যেতেন, যদি তাঁর রক্তপাত হতো, আমার সাহায্য তাঁর প্রয়োজন হতো, আমি অবশ্যই এগিয়ে যেতাম। এতটুকুও কুণ্ঠা বোধ করতাম না। কিন্তু ওখানকার পরিস্থিতি এমন ছিল না। রাজুমা সন্তান হারিয়েছেন, সন্তানহারা মা সারা জীবনের জন্য ক্ষত বয়ে বেড়াবেন।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। কোনো রকমে হাত মেলালাম। তারপর ওই পরিস্থিতিতে আমার বিবেচনায় ঠিক হয় এমন কিছু একটা বলার চেষ্টা করলাম। আমি বাংলায় তাঁকে বললাম, ‘আমি দুঃখিত।’
আমি অল্প কিছু বাংলা শব্দ শিখেছিলাম। সেই শব্দগুলোই উচ্চারণ করতে হয়েছে সবচেয়ে বেশিবার। আমি সব হারানো রোহিঙ্গাদের এই কথাগুলোই বলেছি।
প্রায়ই শুধু বলতে হয়েছে একটি বাক্য। ‘আমি দুঃখিত’ (আই অ্যাম সরি)।