বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছে। কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার মিয়ানমার সীমান্তবর্তী আঞ্জুমানপাড়ায় সরেজমিন দেখা গেছে, সেখানে খোলা আকাশের নিচে ধানখেতে দুই দিন ধরে অপেক্ষা করছে প্রায় ১৫ হাজার রোহিঙ্গা।
গত সোমবার তারা সীমান্ত অতিক্রম করলেও বিজিবি তাদের দেশের ভেতরে প্রবেশে বাধা দিয়েছে। মানবেতর অবস্থায় অপেক্ষমাণদের মধ্যে শিশু ছাড়াও ৮০ বছরের বৃদ্ধ ও গর্ভবতী মায়েরা আছেন।
বিজিবির সদস্যরা গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছেন, ওপরের সিদ্ধান্ত ছাড়া রোহিঙ্গাদের দেশের অভ্যন্তরে ঢুকতে দেওয়া হবে না। তবে তাদের ত্রাণ, চিকিৎসাসহ সব ধরনের মানবিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
মানবিক সহায়তাকারী সংস্থাগুলোর জোট ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) বলছে, গত ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে ৫ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে এখন পুরোনো রোহিঙ্গাসহ কমপক্ষে ১ মিলিয়ন বা ১০ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।
এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরুর পর ২৮৮টি রোহিঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নেওয়া সর্বশেষ ছবি বিশ্লেষণ করে গতকাল মঙ্গলবার সংস্থাটি এ কথা জানিয়েছে।
জেনেভা থেকে ইউনিসেফের মুখপাত্র গতকাল বলেছেন, বাড়তি সহায়তা না পেলে রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
এদিকে গতকাল উখিয়ায় সরেজমিনে দেখা যায়, সরকারি কর্মকর্তা, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, চিকিৎসক সংগঠনসহ অনেকেই ঘটনাস্থলে ভিড় করেছে। এরা কেউ জানে না কেন এই রোহিঙ্গাদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা। গাঢ় সবুজ একটি বিলের মধ্যে এত কষ্টে মানুষের অবস্থানটা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য। মোহাম্মদ রফিক জ্বরে আক্রান্ত চার বছরের ছেলেকে রেখেছেন একটি ঝুড়ির মধ্যে। নিজে দাঁড়িয়ে পায়ের পাতা ডুবে যাওয়া কাদার মধ্যে। তাঁর বাড়ি রাখাইন রাজ্যের বুচিডং এলাকার লম্বাবিল গ্রামে। তিনি জানালেন, গত সোমবার সকালে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। বাপ-ছেলের দুদিনে পেটে কোনো দানা পড়েনি।
ধানখেতের আলটা শুরু হয়েছে আঞ্জুমানপাড়ার মসজিদের কাছ থেকে, এঁকেবেঁকে চলে গেছে মিয়ানমার সীমান্তে। ওপারে মিয়ানমারের কোয়াঞ্চিসাং পাহাড়। দুই দেশের মধ্যে নাফ নদী। মসজিদ থেকে নাফ নদীর পাড় পর্যন্ত আল ধরে শুধু মানুষ আর মানুষ। সোমবার সারা দিন মাথার ওপর খাঁ খাঁ রোদ নিয়ে তারা এই আলের ওপর ছিল। একইভাবে কেটেছে সারা রাত। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ছিল রোদ আর গরম। অসুস্থ হতে থাকে একের এর এক শরণার্থী। হঠাৎ করে দেড়টার দিকে নামে জোর বৃষ্টি। ততক্ষণে শরণার্থীরা আল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। আল তখন বিজিবি, ইউনিসেফ, ইউএনএইচসিআর, চিকিৎসক, সাংবাদিকদের দখলে।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা ডা. মিছবাহ উদ্দিন আহমেদ জ্বরাক্রান্ত এক রোহিঙ্গা নারীকে ভরা পেটে প্যারাসিটামল খাওয়ার পরামর্শ দেন। ওই নারী বলেন, তিন দিন তিনি কিছুই খাননি। পরে মিছবাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার চোখে পানি চলে আসে। ওষুধ নিয়ে সারা জীবনে এমন বিড়ম্বনায় আমি পড়িনি।’
আলের দুই পাশে মানুষ আর মানুষ। পরিবার আলাদা করা কঠিন। সব একাকার। কোনো চিৎকার চেঁচামেচি নেই। এখানে কেউ ত্রাণ দিচ্ছে না। রোহিঙ্গারা কেউ কাদায় দাঁড়িয়ে, কেউ আলের পাশে ভিজে মাটিতে বসে। দেশ থেকে সঙ্গে আনা সামান্য থালা ঘটিবাটি পাশে পড়ে আছে। অতি রুগ্ণ একটি শিশু তার চেয়েও রুগ্ণ মায়ের দুধ খাওয়ার চেষ্টা করছে। আল দিয়ে স্বেচ্ছাসেবকেরা পানির পাত্র নিয়ে যাচ্ছেন। রোহিঙ্গারা পানির পাত্র ধরার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ পাচ্ছেন।
এই বিলে আশ্রয়ের জন্য অপেক্ষমাণ শরণার্থীদের সংখ্যা নিয়ে নানা মত। সোমবার বলা হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার নতুন রোহিঙ্গা ঢুকেছে। গতকাল দুপুরে সরকারি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেছেন, সংখ্যাটি ১৫ হাজারের কিছু বেশি হবে হয়তো। সকাল থেকে চিকিৎসকদের চারটি দল সেখানে কাজ করছিল। তার ভিত্তিতে এই সংখ্যা তাঁরা বলেন।
এরই মধ্যে দেখা যায় এক নারী আলের এক পাশে বসে কাতরাচ্ছেন। তাঁকে ধরে আছেন তাঁর স্বামী। পাশে বছর চারেকের ছেলে। তাদেরও বাড়ি বুচিডংয়ে। ‘কী হয়েছে’ জানতে চাইলে স্বামী বলে, তাঁরা বুঝতে পারছেন না কী হয়েছে। কোথায় যাবেন, তা-ও বুঝতে পারছেন না। এরই মধ্যে বিজিবি সদস্যরা এসে তাঁদের সরে যেতে বলছেন। হতবিহ্বল পরিবারটি বুঝতে পারছে না তারা কী করবে। সরকারি একজন চিকিৎসক স্বামীর হাতে নিজের পানির বোতলটি দিয়ে স্ত্রীকে খাওয়াতে বললেন। আল বেয়ে সামনে এগোলেই নতুন গল্প, নতুন কষ্টের চিত্র। এক যুবক তাঁর মাকে পিঠে করে নিয়ে যাচ্ছেন। মা অসুস্থ।
এই বৃষ্টিকাদায় খাদ্যহীন, পানিহীন মানুষগুলোর মধ্য তারাই কিছুটা ভাগ্যবান, যারা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ছে, যাঁরা সন্তানসম্ভবা বা যারা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। এই তিন ধরনের রোহিঙ্গাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চিকিৎসকদের ছোট মেডিকেল সেন্টারে। এই সেন্টারটি করা হয়েছে মসজিদসংলগ্ন দাখিল মাদ্রাসায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের চারটি দল সাড়ে সাত হাজার রোহিঙ্গাকে কলেরার টিকা খাইয়েছে।
স্থানীয় লোকজনের বরাত দিয়ে টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, সোমবার রাতে শূন্যরেখা থেকে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা গোপনে উখিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। পালংখালী ইউনিয়নের আঞ্জুমানপাড়ার ইউপি সদস্য সুলতান আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল ভোররাত ও সকালের ভারী বর্ষণে শূন্যরেখায় অবস্থান করা হাজারো রোহিঙ্গা ভিজেছে। সেখানে কোনো ছাউনি নেই। আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা ও বেসরকারি কয়েকটি এনজিও কয়েক শ রোহিঙ্গাকে তাঁবু দিলেও সেখানে আরও কমপক্ষে ১২ হাজার রোহিঙ্গা খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।
কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (ভারপ্রাপ্ত) মেজর ইকবাল আহমেদ বলেন, শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গাদের মানবিক সেবা দেওয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে গুপ্তচরসহ অস্ত্রধারী ইয়াবা ব্যবসায়ী থাকতে পারে। সবকিছু যাচাই-বাছাই শেষে রোহিঙ্গাদের উখিয়ার ত্রাণশিবিরে পাঠানো হবে।
কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন আবদুস সালাম বলেন, শূন্যরেখায় অবস্থান নেওয়া রোহিঙ্গাদের সবাইকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হবে। তাদের মধ্যে এইচআইভি ভাইরাসসহ নানা রোগে আক্রান্তরা থাকতে পারে।
আরও দুটি লাশ উদ্ধার
টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাবাহী নৌকাডুবির ঘটনায় আরও দুই রোহিঙ্গা নারীর লাশ ভেসে এসেছে। এ পর্যন্ত ১৩ জনের লাশ পাওয়া গেছে।
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়া ভরাখালে মুখ (ভাঙা) নামক এলাকায় সোমবার ভোররাত চারটার দিকে নৌকাডুবির ঘটনাটি ঘটেছিল। ঘটনার দিন সোমবার দুপুর পর্যন্ত ১১ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। তার মধ্যে পাঁচ শিশু ও ছয়জন নারীর লাশ ছিল।