অস্ট্রেলিয়াতে এসে দুটি শব্দের ব্যবহার শিখলাম একেবারে হাতেকলমে। প্রথমটা হচ্ছে সরি আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে থ্যাংক ইউ। অজিরা কোনো কথা শুরুই করেন সরি দিয়ে। যদি তারা আপনার কথা বুঝতে না পারে তাহলে সরি বলে আপনাকে সেটা আবার বলতে বলবেন। কিন্তু সরি শব্দটা বলবেন বাধ্যতামূলকভাবে। অনেক সময় সরির সঙ্গে আই বেগ ইয়োর পার্ডনও বলেন। চলার পথে হয়তো কারও সঙ্গে মৃদু ধাক্কা খেয়েছেন, আপনাকে এতবার সরি বলবেন যে, আপনার মন ভালো হয়ে যাবে। ভিড়ের মধ্যে বাসে ট্রেনে উঠতে গিয়ে হয়তো একটু ঠোকাঠুকি লেগেছে, আপনাকে সরি বলবে। দোকানে কোনো কিছু কিনতে গিয়ে বাচ্চাটা ছুটে আপনার সামনে দিয়ে দৌড় দিয়েছে। এতে হয়তো আপনার কোনো সমস্যা হয়নি তবুও বাচ্চার পক্ষ থেকে আপনাকে সরি বলবে।
বাস-ট্রেনের চালক, দোকানের বিক্রেতা সবাই অনবরত এই শব্দটার চর্চা করে যাচ্ছেন। বাসে আর তিল ধারণের জায়গা নেই, তখন বাসের চালক বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ানো যাত্রীদের আন্তরিকভাবে সরি বলে বলবেন, আমি আর যাত্রী নিতে পারছি না, আপনারা পরের বাসে আসুন। ট্রেন কোনো কারণে যদি কোথাও দেরি করে ফেলে ট্রেনের চালক মাইক্রোফোনে প্রথমেই বলবেন, সরি। তারপর দেরির কারণটা ব্যাখ্যা করবে। কোনো দোকান হয়তো বন্ধ তাহলে অবধারিতভাবে সেখানে একটা নোটিশ থাকবে, সরি উই আর ক্লোজ। আসলে আপনি কাউকে সরি বললে তার কাছে আপনার সম্মান বেড়ে যায়। তখন সেই মানুষটাও অনেক বেশি মনযোগ দিয়ে আপনার কথা শুনবেন এবং সেটা সমাধানের চেষ্টা করবেন।
অজিরা থ্যাঙ্ক ইউ শব্দটাও খুবই বেশি ব্যবহার করেন। প্রথমে আপনাকে সরি বলে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার পর উত্তরটা পেয়ে অবশ্যই আপনাকে তারা ধন্যবাদ দিয়ে থ্যাংক ইউ বলবেনই এবং সেটা একাধিকবার। অনেক সময় থ্যাংক ইউয়ের সঙ্গে কিছু মিষ্টি সম্বোধন যোগ করেন। আমি একবার বাসস্ট্যান্ডের একটা চেয়ারে বসে বাসের অপেক্ষায় ছিলাম। একজন ভদ্রমহিলা তার বাচ্চাকে স্ট্রলারে নিয়ে ঠেলতে ঠেলতে সেখানে এলেন। আমি আমার সিট ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি প্রথমে বললেন, না তুমি বস, আমি ঠিক আছি। আমি বললাম, না তুমি বস আমি ঠিক আছি। তখন তিনি বসতে বসতে বললেন, থ্যাংক ইউ ডার্লিং। অন্য একদিন একইভাবে বসে বাসের জন্য অপেক্ষায় আছি। একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা আসলেন দেখে আমি আমার সিট ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। এবারও একই ঘটনা ঘটল। ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন, থ্যাংক ইউ হানি। বাস-ট্রেনে আপনি এমন কাউকে সিট ছেড়ে দিলে বা একটু চেপে বসলেও আপনি এমন ধন্যবাদ পাবেন।
এ ছাড়া আরও কিছু মন ভালো করে দেওয়ার ব্যাপার আছে। আপনি রাস্তায় হাঁটছেন, একেবারে নিতান্ত অপরিচিত মানুষ আপনার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আপনাকে সময়ের ক্ষণ অনুযায়ী বলবেন, গুড মর্নিং, গুড আফটার নুন, গুড ইভিনিং বা গুড নাইট। অনেক সময় আপনাকে বলবেন, হাউ আর ইউ মেট? যেটা শুনতে আমার কাছে অনেকটা হাউ আর ইউ মাইটের মতো লাগে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা অজি উচ্চারণে অনেক দ্রুত বলাতে সেটা বোঝা একটু মুশকিল হয়ে যায়। খুবই দ্রুত হাউ আর ইউ কে তারা বলে হাউ আই আ। আপনি কেমন আছেন সেটা বলে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে একইভাবে তাকেও জিজ্ঞেস করতে পারেন তিনি কেমন আছেন। তাহলে তিনিও কেমন আছেন জানিয়ে আপনাকে ধন্যবাদ দেবেন। এ ছাড়া তখনকার আবহাওয়াটা কেমন সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত মন্তব্যও করতে পারেন। যেমন শীতের সময় বলতে পারেন, ইটস ভেরি কোল্ড টুডে। গরমের সময় ইটস ভেরি হট টুডে। এ ছাড়া যদি তখন অনেক বাতাস বয় তাহলে বলতে পারেন, ইটস ভেরি উইন্ডি টুডে বা আবহাওয়াটা নাতিশীতোষ্ণ হলে বলতে পারেন ইটস ভেরি নাইস অ্যান্ড ওয়ার্ম টুডে।
এর বাইরেও তারা যেকোনো কথা বা কাজের শেষে অবশ্যই আপনাকে আশীর্বাদ বা দোয়া করবেন। আপনি কোনো একটা কিছু করতে যাচ্ছেন তাহলে অবশ্যই আপনাকে বলবেন, গুড অন ইউ। আপনি কোনো দোকানে গিয়ে কেনাকাটা শেষ করলেন, তাহলে একেবারে শেষে বিক্রেতা অবশ্যই আপনাকে সময়ের ক্ষণ অনুযায়ী বলবেন, হ্যাভ এ নাইস মর্নিং, হ্যাভ এ নাইস আফটার নুন, হ্যাভ এ নাইস ইভিনিং, হ্যাভ এ নাইস নাইট বা হ্যাভ এ নাইস ডে। একইভাবে আপনি বাস থেকে নামার সময় যদি বাসের চালককে ধন্যবাদ দেন, তিনি অবশ্যই আপনাকে সময়ের ক্ষণ অনুযায়ী এগুলো বলবেন। আপনি শুক্রবারে অফিস শেষ করে বাসার উদ্দেশে রওনা নিয়ে সবার কাছে বিদায় নিচ্ছেন তাহলে অবশ্যই আপনাকে তারা বলবেন, হ্যাভ এ নাইস উইকএন্ড। অথবা আপনি ছুটি নিয়ে কোথাও যাচ্ছেন তাহলে অবশ্যই আপনাকে বলবেন, হ্যাভ এ নাইস হলিডে, এনজয়। এমনকি সপ্তাহান্তে বাসের চালকও যাত্রীদের এগুলো বলে আশীর্বাদ করে থাকেন।
এই ব্যাপারগুলো আমাকে খুবই মুগ্ধ করে। এই কথাগুলো যখন বলেন তখন তাদের মুখ থাকে হাসি হাসি ভাব। যেটাকে আমরা বলি মুচকি হাসি। হাসি দিলে আসলে যেকোনো সম্পর্কই দ্রুতই আপন হয়ে যায়। এক সময় আমি এগুলোর শেকড় অনুসন্ধান করার একটু চেষ্টা করলাম। দেখলাম এগুলো একটা মানুষকে তার একেবারে শিশু অবস্থা থেকে শেখানো হয়। আমি একদিন বেশ কিছু চকলেট কিনে বিক্রেতার সামনের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি দাম দেওয়ার জন্য। আমার সামনেই একজন ভদ্রমহিলা তখন তার সদাইয়ের দাম দিচ্ছিলেন। সঙ্গে একটা বাচ্চা ছিল। বাচ্চাটি আমার চকলেটের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে আমি তাকে একটা দিলাম। ভদ্রমহিলা তখন আমাকে বললেন, এটার দরকার ছিল না। পরে বাচ্চাটাকে বললেন, তুমি ধন্যবাদ দাও। বাচ্চাটা সঙ্গে সঙ্গে তার শিশুসুলভ কণ্ঠে আমাকে ধন্যবাদ দিল। সামান্য একটা চকলেটের বিনিময়ে এমন অপার্থিব একটা ধন্যবাদ পেয়ে মনটাই ভালো হয়ে গেল।
ইদানীং দেখি আমি আমার মেয়েটার জন্য কোনো কিছু করলে মেয়েও সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। সেটা শুনে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি এটা কীভাবে জানো। কারণ আমি আমার কাছের মানুষদের মধ্যে ধন্যবাদ দেওয়া থেকে বিরত থাকি। মেয়ে বলল, সে এটা স্কুল থেকে শিখেছে, তার ক্লাসের ম্যাডাম তাকে বলেছে কেউ তার জন্য কিছু করলে তাকে ধন্যবাদ দিতে। আসলে একটা দেশ বা জাতি তখনই ভদ্র বা সভ্য হয় যখন তার শিশুরা সঠিক শিক্ষাটা পায় পরিবার, সমাজ ও স্কুল থেকে। কারণ তারাই একদিন বড় হয়ে এক একজন পরিপূর্ণ মানুষ হবে এবং তারাও তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এটা শিখিয়ে যাবে। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এগুলো চলতে থাকবে। আর মানুষে মানুষে এই সৌহার্দ্যই মানব জাতিকে তার সভ্যতায় আরও এক ধাপ এগিয়ে দেবে।