ড. মং জার্নির জন্ম ১৯৬৩ সালে মিয়ানমারের মান্দালয়ে। তিনি মিয়ানমারের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে পাশ্চাত্যে সবচেয়ে সোচ্চার ব্যক্তিদের অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং উইসকনসিন-মেডিসন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। শিক্ষকতা করেছেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস, অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ডে। ১৯৯৫ সালে তিনি প্রবাসী বর্মি ভিন্নমতাবলম্বীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ফ্রি বার্মা কোয়ালিশন। ৩০ বছর ধরে মিয়ানমারের মানবাধিকারের প্রবক্তা হওয়ার কারণে বর্মি সরকার ও তাদের সমর্থক মিডিয়ার কাছে তিনি ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’, এমনকি তাঁকে ‘জাতীয় বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে।
গত ২১ সেপ্টেম্বর কুয়ালালামপুরের পুলম্যান হোটেলে তাঁর সঙ্গে কথা বলা এবং পরে ই-মেইল যোগাযোগের ভিত্তিতে এই সাক্ষাৎকার তৈরি করা হলো। গত ১০ অক্টোবর এর প্রথম আলোর মুদ্রিত সংখ্যায় সাক্ষাৎকারটির সংক্ষেপিত অংশটি প্রকাশিত হয়। আজ বাকি অংশ প্রকাশিত হলো।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো: সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে একজন বর্মি মন্ত্রী ঢাকা ঘুরে গেলেন। আপনি আশাবাদী?
মং জার্নি: ১৯৬২ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় আসার পর মিয়ানমার তার বৃহত্তম জাতীয় সংকট মোকাবিলায় তিনজন বেসামরিক কূটনীতিককে নিয়োগ দিয়েছে। কিউতিন স অং সান সু চির নিজ দপ্তরের মন্ত্রী এবং তাঁর মূল অনুঘটক। আপনারা তাঁকে বিশ্বাস করলে ঠকবেন। ২০০৮ সালের মে মাসে বন্যাদুর্গত লোকজন যখন চরম সংকটে, তখন তাঁকে সরকারের পক্ষে ওকালতি করতেই শশব্যস্ত দেখা গেছে।
এরপর আছেন থং তুন, তিনি বর্তমানে সু চির জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপদেষ্টা। ইতিপূর্বে আধা অবসরে যাওয়া জেনারেল থান শয়ের দোভাষীর কাজ করেছেন। আর আছেন উইন ম্রা। তিনি মিয়ানমারের বর্তমান মানবাধিকার কমিশনের প্রধান। আনান কমিশনের অন্যতম সদস্য এই ভদ্রলোকের কর্ণকুহরে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা শব্দটিই প্রবেশ করেনি। বিশ্বে বর্তমানে মিয়ানমারের যে ৩০ জনের বেশি রাষ্ট্রদূত কর্মরত রয়েছেন, তাঁরা কেউ সাবেক কর্নেল, কেউ সাবেক ব্রিগেডিয়ার। তাঁরা পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। গত সপ্তাহে থং তুনকে নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানো হয়েছিল। নিউইয়র্কে তিনি কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনসের মতো মার্কিন স্টাবলিশমেন্ট কাজে লাগিয়ে অপপ্রচার চালিয়েছেন।
আমি মনে করি, ওই তিনজন বেসামরিক কূটনীতিকের সারা জীবন কেটেছে আন্তর্জাতিক ফোরামে সামরিক বাহিনীর পক্ষে নির্লজ্জ দালালি করে। তাঁরা প্রত্যেকে ধূর্ত এবং মুসলিমবিদ্বেষী বর্ণবাদী। তাঁদের কারও হৃদয়ে এক তোলা পরিমাণও নীতিবোধ কিংবা মানবিক অনুভূতি নেই। সু চি এসব ব্যক্তি দ্বারা পরিবেষ্টিত। তাঁদের আমি বিষাক্ত সাপ হিসেবে চিহ্নিত করতে দ্বিধাবোধ করি না। বাংলাদেশকে প্রত্যাবাসনের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। মনে রাখতে হবে, তাঁদের চূড়ান্ত স্ট্র্যাটেজিক স্কিম হচ্ছে রোহিঙ্গাদের জাতিসত্তা, তার ইতিহাস, পরিচিতি ও আইনগত অবস্থান ধ্বংস করা। আপনাদের মনে যদি এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ দানা বাঁধে, তাহলে গত ২৫ বছরের জাতিসংঘের ডকুমেন্টগুলো, মানবাধিকারের নথিপত্র এবং ১৯৭৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রেস ক্লিপিংগুলো পাঠ করুন। রোহিঙ্গারা বাড়ি ফিরতে চায় না।
প্রথম আলো: তাহলে সু চির প্রতি আমরা ভরসা করব না?
মং জার্নি: আমি বহু বছর আগে তাঁর সম্পর্কে যা লিখেছিলাম, তা তখন বিশ্বাস করতে অনেকেরই কষ্ট হতো। তাঁরা তাঁকে রোমান্টিসিজমের জায়গা থেকে প্রশ্রয় দিতেন। কিন্তু তাই বলে তাঁর সর্বাত্মক ও গভীর বর্ণবাদী মন একটুও বদলে যায়নি। আমি যখন তাঁর নৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক ও নেতৃত্বের যথাযথ সমালোচনা করেছি, তখন তাঁর সমর্থকেরা কষ্ট পেয়েছেন। একটি সামরিক পরিবারে আমার বেড়ে ওঠার সময় তাঁর বাবা ছিলেন আমার রোল মডেল। ১৯৮৮ সালের জুলাই মাসে আমি যখন আমার দেশ ত্যাগ করি, তখন আমার ওয়ালেটে তিনটি ছবি ছিল। একটি আমার পরিবারের, দ্বিতীয়টি মহামুনি বুদ্ধের এবং অপরটির অং সানের পরিবারের। এই ছবিতে সু চি ছিলেন দুই বছরের। মাঠের কর্মী হিসেবে আমি সু চির পক্ষে কথা বলেছি একটানা ১৫ বছর। তিনি যেভাবে স্বেচ্ছায় বিরোধী শিবিরে প্রবেশ করেছিলেন, তা তিন দশকের মধ্যে প্রথম গণ-অভ্যুত্থান এনেছিল। তাঁকে সমালোচনায় আমার কোনো ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বা হিংসা নেই। আমি কোনো রাজনীতিবিদের আনুগত্যে বা অনুরাগী হতে বিশ্বাসী নই, কারণ তাঁরা প্রত্যেকেই খুব বেশি মনুষ্য প্রজাতির। আমি একজন কর্মী হিসেবে ‘আমার দেশ সেরা, সেটা ভুল বা শুদ্ধ যা-ই করুক’ ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়াকে নাকচ করে দিই।
প্রথম আলো: বর্মি ভাষায় তিনি তাঁর জনগণকে কী বলে থাকেন, সেটা আমাদের জানার কৌতূহল আছে।
মং জার্নি: ৬ অক্টোবর সু চি ব্রুনাইয়ে বর্মি বিশেষজ্ঞদের কাছে তাঁর সরকারকে ‘নিষ্পাপ’ বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘আমাদের বিবেক পরিষ্কার। কিন্তু আমি বলব না যে আমরা কোনো ভুল করিনি। তবে আমরা অবশ্যই কোনো অন্যায্য কিছু করিনি। আমরা যদি অজান্তে কোনো অন্যায় করে থাকি, তাহলে প্রচলিত আইনমতে তা শুধরে নেব।’ অথচ তিনি একটিবারের জন্য বাস্তুচ্যুত কাউকে দেখতে রাখাইন সফরে যাননি। এই নারীর ঔদাসীন্য ও অমানবিকতা কী হতে পারে, তা কারও ধারণার বাইরে।
প্রথম আলো: চীন, রাশিয়া ও ভারতের ভূমিকা কি সংকট নিরসনে বড় বাধা?
মং জার্নি: অবশ্যই। চীন ও রাশিয়া এমনকি উদ্বেগ জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে বিবৃতি দিতে রাজি হয়নি। ভারতে উগ্র বর্ণবাদী দল ক্ষমতায়। তারা হিন্দু মৌলবাদী জাতীয়তাবাদকে উসকে দিতে চাইছে। সু চি-মোদির যৌথ ঘোষণা বলছে, তারা নাকি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় লড়াই করতে একমত। এর মাধ্যমে ভারত কার্যত সু চির বর্ণবাদী গণহত্যার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। আবার পশ্চিমা কোনো প্রভাবশালী দেশই কিন্তু এই তিন দেশের সমালোচনা করছে না। পাশ্চাত্য যারা মানবাধিকার, বিশ্বশান্তি ও নাগরিক স্বাধীনতার কথা বলে, তারাই তেলের জন্য অন্যের ভূখণ্ড দখল করতে পারে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে আমি পশ্চিম ও পূর্ব ব্লকের মধ্যে কোনো ফারাক দেখি না। তাই রাশিয়া, চীন ও ভারত নয়, পাশ্চাত্যও একইভাবে ভণ্ড। পাশ্চাত্য সার্বিয়া ও বেলগ্রেডে বোমা ফেলেছে। মিলেসোভিচের প্যালেসেও বোমা ছুড়েছে। মিলেসোভিচ সার্বিয়া ও বসনিয়ার মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল। ইসরায়েলের বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদ ২৩০টির বেশি প্রস্তাব পাস করেছে। কিন্তু তারা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলেছে। তাই আমি এটা বলব না, এই তিন দেশই মিয়ানমারের গণহত্যা বন্ধে বাধা তৈরি করেছে। তবে আমরা মনে রাখব, নিরাপত্তা পরিষদই জীবন ও ইতিহাসের যবনিকা নয়।
প্রথম আলো: আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (আইসিসি) এর বিচার হতে পারে? আশাবাদী?
মং জার্নি: না। আমি আশাবাদী নই। কিছু আন্তর্জাতিক আইনি সংগঠন রোহিঙ্গাদের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে দরখাস্ত করেছিল। তারা দুই বছর পর উত্তর দিয়েছে যে মিয়ানমারের ওপর তাদের বিচারিক এখতিয়ার নেই। ১৯৪৯ সালে বার্মা জেনোসাইড কনভেনশনে সই করেছিল, যা ১৯৫০ সালে কার্যকর হয়। কিন্তু যেটা ঘটেছে, সেটা হলো তারা তাতে শর্ত সাপেক্ষেÿসই করেছিল। ওই শর্তে বলা আছে, জেনোসাইডের অভিযোগে দেশটির নেতাদের বিচার করা যাবে না। জেনোসাইড কনভেনশন বা আন্তর্জাতিক আইন কোনো রকেটবিজ্ঞান নয়।
প্রথম আলো: আইসিসি সংবিধিতে তারা সই করেনি।
মং জার্নি: সই করাটাই অপরিহার্য নয়। জাতিসংঘের কোনো সদস্য রাষ্ট্র যদি গণহত্যা করে, তাহলে তাকে জবাবদিহির আওতায় আনা যাবে।
প্রথম আলো: নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগের কথা আমরা জানি। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কী?
মং জার্নি: অমর্ত্য সেনের সঙ্গে অং সান সু চির প্রয়াত স্বামী মাইকেল অ্যারিসের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। তা ছাড়া অক্সফোর্ডে যাওয়ার আগে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সু চিকে অর্থনীতি পড়াতেন অমর্ত্য। সুতরাং, সু চির প্রতি অমর্ত্যের একটা অনুরাগ রয়েছে। যদিও আজকের বার্মায় অমর্ত্যকে কেউ হয়তো বাঙালি বিবেচনায় হত্যা করতে পারে! ২০১৩ সালে সু চি যখন প্রথম হার্ভার্ডে এলেন, তখন তাঁর সম্মানে দেওয়া নৈশভোজে সু চি-অমর্ত্য পাশাপাশি বসেছিলেন। অমর্ত্যকে আমি রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেছিলাম। পরে অমর্ত্য আমাকে বলেছেন, ‘আমি তাকে বলেছি, তুমি জাতির নেত্রী। তোমাকে মিয়ানমারের প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিতে হবে। তোমার সবাইকে সমভাবে রক্ষা করতে হবে।’ উত্তরে সু চি বলেছিলেন, তিনি সেই চেষ্টাই করছেন। দু-তিন মাস আগে অমর্ত্যর সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, সু চি কেন এমনটা করছেন? আমি বললাম, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তিনি (সু চি) একজন বর্ণবাদী। তবে নোবেল বিজয়ীদের সাম্প্রতিক বিবৃতির প্রশ্নে অমর্ত্য কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। অন্যদের সঙ্গে তাঁরাও রোহিঙ্গা-সংক্রান্ত একটি বিবৃতিতে সই দেন। সাধারণত, অমর্ত্য কোনো বিবৃতিতে সই দেন না। সু চির তৎপরতায় অমর্ত্য সত্যিই হতাশ।
প্রথম আলো: অমর্ত্য সেন কি মিয়ানমার সফর করতে পারেন না?
মং জার্নি: সেই অনুরোধ আমি তাঁর কাছে রেখেছিলাম। কিন্তু তিনি ‘কালা’ (রোহিঙ্গা) বিরোধিতার সবটাই অবগত আছেন। তিনি তাঁর শৈশব কাটান ঢাকা ও মান্দেলেতে। মান্দেলের একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বাবা অধ্যাপনা করতেন। অমর্ত্য আমাকে বলেছেন, তিনি এখন মিয়ানমার সফরে গিয়ে তাঁর শৈশবের মধুর স্মৃতি ধ্বংস হতে দিতে চান না। তিনি এখন গিয়ে দেখবেন, মানুষ কতটা বর্ণবাদী ও ঘৃণাবিদ্বিষ্ট।
প্রথম আলো: বর্মিরা রোহিঙ্গাদের কেন ‘কালা’ বলে আমরা তা জানি না।
মং জার্নি: কুলা বা কালা। কালা মানে ধর্ম-গোত্রনির্বিশেষে ভারতীয় সভ্যতার মানুষ। বুদ্ধ কালা, ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মানুষও কালা বলে পরিচিত। বুদ্ধ কিন্তু বর্মি নন।
প্রথম আলো: প্রভাবশালী স্বাধীন পশ্চিমা মিডিয়া কেন সরকারি সুরে এথনিক ক্লিনজিং ব্যবহারের প্রবণতা দেখাচ্ছে? এটা উদ্দেশ্যমূলক?
মং জার্নি: আমি মনে করি, অনেক সাংবাদিক জেনোসাইড লিখেছেন, তার মধ্যে জেনে বা না জেনেও করছেন। কারণ, তাঁদের সময় নেই এ নিয়ে অধ্যয়ন করার। কিন্তু জাতিসংঘ সুচিন্তিতভাবে নীতি হিসেবে নিয়েই জেনোসাইডকে জেনোসাইড বলছে না। এ জন্য তারা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। এমনকি জাতিসংঘের শীর্ষ মানবাধিকার-প্রধান এথনিক ক্লিনজিং কথাটি ব্যবহার করছেন। এটা অসততা। তাঁরা রাজনীতির খেলা খেলছেন। তাঁরা জানেন, জেনোসাইড শব্দ উচ্চারণ করা মাত্রই জাতিসংঘের ১৯০টি সদস্য রাষ্ট্র এবং তাঁদের পক্ষে মিয়ানমারের বিচার করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়বে। তাঁরা তখন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগে দায়বদ্ধ হয়ে পড়বেন। ভারত ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানি জেনোসাইড বন্ধে সশস্ত্র সহায়তা দিয়েছিল। জাতিসংঘ রোহিঙ্গা জেনোসাইড বন্ধে কিছু করবে, তা আমি বিশ্বাস করি না। তারা সেই সামর্থ্যও রাখে না। পলপট কম্বোডিয়ার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ চার বছরের কম সময়ের ব্যবধানে নিশ্চিহ্ন করেছিল। এর ৪০ বছর পরে জাতিসংঘ একটি হাইব্রিড ট্রাইব্যুনাল করেছিল। তাতে দেশটির সরকার ও জাতিসংঘ যৌথভাবে অংশ নিয়েছিল। দাতারা সেই বিচারের জন্য ১০ বছরে ৩০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল। তিন শীর্ষ খেমারুজ যুদ্ধাপরাধীর বিচারও হয়েছিল। কিন্তু জাতিসংঘ সেখানেও জেনোসাইড শব্দটি ব্যবহার করেনি। তাই আমি মনে করি, জাতিসংঘ বা নিরাপত্তা পরিষদ কারও ওপরই ভরসা নেই। কারণ, তারা বিশ্বের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। বিশ্ব যদি জনগণের আইনে চলত, তাহলে বিশ্ব আরও শান্তিপূর্ণ হতো।
প্রথম আলো: অনেক পশ্চিমা মিডিয়া এথনিক ক্লিনজিং কথাটি বেশি ব্যবহার করছে কেন?
মং জার্নি: এটা অপসাংবাদিকতা। সত্যি তারা অন্ধের মতো জাতিসংঘের সুরে কথা বলে। আল-জাজিরার সংবাদদাতা জেমস জাতিসংঘের মহাসচিবকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কি এটাকে এথনিক ক্লিনজিং বলবেন?’ জবাবে আন্তোনিও গুতেরেস প্রশ্ন আকারে বলেন, সেখানে যা ঘটছে, তাকে বর্ণনা করতে এর চেয়ে শক্তিশালী আর কী পরিভাষা আমি ব্যবহার করব? তখন জেমসের বলা উচিত ছিল, কেন, এর থেকে কার্যকর ও জোরালো পরিভাষা হলো জেনোসাইড।
প্রথম আলো: মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ চুক্তি করেছে যে তারা রোহিঙ্গা শব্দ ব্যবহার করবে না, সেটা ভুল ছিল?
মং জার্নি: অবশ্যই ভুল ছিল। কোনো একটি জাতিগোষ্ঠীর জাতিসত্তার পরিচয় কী হবে বা হবে না, সে বিষয়ে কোনো সরকারের কোনো চুক্তি করার কোনো এখতিয়ার নেই। কারণ, আন্তর্জাতিক কোনো আইন এটা সমর্থন করবে না। জাতিগত সংখ্যালঘুরাই ঠিক করবে কী নামে তাদের ডাকা হবে। আপনার নাম মিজান, আমি আপনাকে মাইকেল বলতে পারি না। আপনি বাঙালি, আমি পূর্ব পাকিস্তানি বলতে পারি না। কেউ এ নিয়ে কোনো চুক্তি করতে পারে না। স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের মিলিটারি ধরে নিয়ে যায়, এরপর জিজ্ঞেস করে তোমার পরিচয় কী? তারা রোহিঙ্গা বলামাত্রই কিল-ঘুষি শুরু করে দেয়। তখন নাকমুখ থেকে রক্তঝরা অবস্থায় তারা বলে, আমি বাঙালি।
প্রথম আলো: বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু (Refugee) হিসেবে দেখতে অপারগ। আপনি কীভাবে দেখেন?
মং জার্নি: বাংলাদেশ সরকারের উচিত একটি নীতি ও কৌশলসংক্রান্ত ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা। নাগরিক সমাজ, নীতিসংক্রান্ত উপদেষ্টা সবারই এতে অংশ নেওয়া উচিত।
প্রথম আলো: ১৯৭৮ সালে কী ঘটেছিল?
মং জার্নি: নে উইন প্রশাসন তত দিনে রোহিঙ্গা শব্দ মুছে দিয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে, রেডিওতে মিডিয়ার কোথাও আর রোহিঙ্গা শব্দ শোনা যায়নি। তিনি একটি সন্ত্রাসী অভিযান চালালেন। ১৯৭৮ সালের জুলাইয়ে ব্যাংকক পোস্টে খবর বেরিয়েছিল, জিয়া-নে উইন সভার সাইডলাইনে জিয়া হুমকি দিয়েছিলেন রোহিঙ্গাদের অস্ত্র দেওয়ার। তখন অস্ত্র দিলে বার্মার ওই অংশ যুদ্ধ এলাকায় পরিণত হতো। পরে সেই সময়ে কুয়ালালামপুরে আশ্রয় নেওয়া শিক্ষিত ও ধনাঢ্য রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছিলেন।
প্রথম আলো: কুয়ালালামপুরের গণ-আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসা নারীরা তাঁদের গোপন জবানবন্দিতে কী বলেছেন?
মং জার্নি: চোখের জলে ভেসে গোপন জবানবন্দি দিয়েছেন ২০১২ সালে দেশত্যাগী এক নারী। বিচারকেরাও কেঁদেছেন। তখন ১৭ বছর বয়স ছিল। এখন ২৩। তিনি প্রথমে বাংলাদেশি একটি শরণার্থীশিবিরে ধর্ষণের শিকার হন। অন্য নারীদের সঙ্গে নৌকায় থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় পালান। টানা তিন মাস তিনি নৌকায় ধর্ষণের শিকার হন।
প্রথম আলো: আপনি কি মনে করেন, সেই হুমকির কারণে এবার আমরা অধিকতর পুরুষশূন্য উদ্বাস্তু স্রোত দেখছি?
মং জার্নি: আমি তা-ই মনে করি। সেই হুমকির কথা তারা নিশ্চয় মনে রেখেছিল। আজ যারা বাংলাদেশে এসেছে, তাদের ৩০ শতাংশ শিশু, যাদের অধিকাংশই এতিম। বাকিদের বড় অংশ নারী। এবারের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সার্ব্রিনিৎসার গণহত্যার মিল রয়েছে। সেখানেও একই ধরনের গণহত্যার পর মানুষ সব ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল। নারী ও শিশুদের থেকে পৃথক করে পুরুষদের ঠান্ডা মাথায় লাইন ধরে তারা পাইকারি হত্যা করেছে। নাৎসি জার্মানিও তাই প্রত্যক্ষ করেছে। নারী ও শিশুদের থেকে পুরুষদের আলাদা করা গণহত্যাজনিত আচরণের একটি ধ্রুপদি দৃষ্টান্ত।
প্রথম আলো: রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আপনি ও ড. অ্যালিস কাউলি যৌথভাবে যাকে ‘স্লো বার্নিং জেনোসাইড’ চলছে বলে দাবি করেছেন, তার প্রক্রিয়া মিয়ানমারে কখন, কীভাবে শুরু হয়েছিল?
মং জার্নি: ১৯৬৬ সালে। আমি আমার লেখায় বলেছি, ১৯৭৮ সালেই ব্যাপকভিত্তিক নির্যাতন করে রোহিঙ্গাবিরোধী গণহত্যার প্রথম বছরটি শুরু হয়। কিন্তু এর ১২ বছর আগে গণহত্যার নীলনকশা তৈরি করা হয়। সেই বছরে সামরিক বাহিনী উত্তর আরাকানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে কৃত্রিমভাবে বৌদ্ধ জনসংখ্যা বাড়িয়ে রোহিঙ্গাদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার উদ্যোগ নেয়। কারাগারে থাকা দুর্বৃত্তদের সাজা অর্ধেক কমানোর মুলা ঝুলিয়ে আরাকানে বসতি গড়ার জন্য প্রলুব্ধ করা হয়। আর এটাই কালক্রমে গণহত্যার পটভূমি তৈরি করে। তাই আমি ১৯৬৬-কে জেনোসাইডের জেনেসিস বলি। ২০১২ সালে আমি প্রথম এক নিবন্ধে এটা লিখি। ব্রিটিশ শিক্ষিত রোহিঙ্গারা জেনোসাইড কথাটি ৭৮ সালেই ব্যবহার করা শুরু করেছিল।
বাষট্টিতে নে উইন ক্ষমতায় এলেন। সেটা বহু সংস্কৃতিগত বর্মি সমাজের যবনিকা টেনেছে। ১৯৪৮ সালে প্রথম নাগরিকত্ব আইনে কোনো জাতিগত সংখ্যালঘু স্বীকৃত হয়নি। কিন্তু পরে কয়েক মাসের মধ্যে আইন সংশোধন করে ১৯৪২ সালে জাপানি আগ্রাসনের আগে যারা বার্মায় ছিল, তাদের সবাইকে আপনা-আপনি নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। আরাকানি জাতিগত সংখ্যালঘু, যার মধ্যে রোহিঙ্গা, মগ, বর্মিজ, শান, কাইয়া, কাচিনসহ আটটি গোষ্ঠী ছিল। তখন রোহিঙ্গারা আরাকানের নেটিভ হিসেবে গণ্য হয়। তাদের পরিচয় ছিল আরাকানি। এখনো তাঁদের নাগরিক পরিচয় সেটাই থাকা উচিত।