বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ গরমকালে দেশে হত্যা, চুরি, ডাকাতি, অপহরণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বেড়ে যায়। এর সঙ্গে বাড়ে মামলার সংখ্যাও। বছরের প্রথম ও শেষ চার মাসে অপরাধের মাত্রা থাকে তুলনামূলকভাবে কম। পুলিশ সদর দপ্তরের গত পাঁচ বছরের অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে বছরজুড়ে অপরাধের এই তারতম্যের চিত্র পাওয়া গেছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে অপরাধ সংঘটনের এই ধারা অব্যাহত আছে। কিন্তু এই তারতম্যের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনো বের করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ নিয়ে সরকারের কোনো সংস্থা বা কোনো গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা নেই। সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত একটি দল এ নিয়ে কাজ করেছিল। কিন্তু ‘প্রয়োজনীয় তথ্যের’ অভাবে তারা এর সঠিক কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। তারা মাঠপর্যায়ে জরিপের মাধ্যমে কারণ অনুসন্ধান করার জন্য মতামত দিয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (নীতি ও গবেষণা) আবদুর রাজ্জাক বলেন, অপরাধের এই তারতম্যের অন্যতম প্রধান কারণ হলো তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে মানুষ অস্বস্তিবোধ করে। অনেকে নিজের অজান্তে সহিংস আচরণ করতে থাকে। তাঁর মতে, গরমকালে মানুষের সক্রিয়তা বেড়ে যায়। এ সময় দিনের আলো বেশি সময় ধরে থাকে, সূর্যাস্তের পরও অনেক রাত পর্যন্ত মানুষের স্বাভাবিক কার্যক্রম চলে। মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড যেমন বেড়ে যায়, তেমনি অপরাধের মাত্রাও বাড়ে।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান থেকে ২০১২-২০১৬ সাল পর্যন্ত মাসভিত্তিক মামলার সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত মামলার সংখ্যার কাছাকাছি থাকে। মে মাস থেকে এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। আগস্ট মাস পর্যন্ত চলে এর ধারাবাহিকতা। এরপর সেপ্টেম্বর মাস থেকে আবার মামলার সংখ্যা কমতে থাকে। এর মধ্যে বছরের প্রথম দুই মাস এবং শেষ দুই মাসের মামলার সংখ্যা থাকে প্রায় একই রকম।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০১২ সালের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) সারা দেশে মোট ৫৯ হাজার ৬২৫টি মামলা হয়। পরের চার মাসে (মে-আগস্ট) এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫ হাজার ১৮৪টিতে। আবার বছরের শেষ চার মাসে (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) সেই সংখ্যা কমে ৫৮ হাজার ৫৯৮টি হয়। অর্থাৎ প্রথম চার মাস থেকে পরের চার মাসে মামলার সংখ্যা বেড়ে যায় ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। এরপর মাঝের চার মাসের চেয়ে শেষ চার মাসে মামলার সংখ্যা কমে যায় ১১ দশমিক ২৪ শতাংশ।
এর পরের চারটি বছরের চিত্রও প্রায় একই। ২০১৩ সালে প্রথম চার মাসের চেয়ে পরের চার মাসে (মে-আগস্ট) মামলা বেড়ে যাওয়ার হার ছিল ১২ দশমিক ৯৯ শতাংশ, ২০১৪ সালে ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ, ২০১৫ সালে ১৮ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ৯ শতাংশ।
অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ফরেনসিক সাইকিয়াটিস্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক খসরু পারভেজ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মানসিকভাবে অস্থির লোক অপরাধ করে। তাই বলে সব অপরাধী মানসিক রোগী নয়। এ ক্ষেত্রে তাপমাত্রা একটি কারণ হতে পারে। তবে অপরাধ বেড়ে যাওয়ার পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মূল্যস্ফীতি অর্থাৎ যেসব বিষয় মানুষকে অস্থির করে তোলে, সেসবও প্রভাব রাখে।
এ বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে গঠিত কমিটির প্রধান ছিলেন সিআইডির উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ভানু লাল দাস। অপরাধবিজ্ঞান নামে একটি বইয়েরও গ্রন্থকার তিনি। তিনি বলেন, প্রতিবছর মাসভিত্তিক অপরাধের এই তারতম্যের বিষয়টা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এর পেছনে সাধারণত যেসব কারণ বলা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই অনুমাননির্ভর। সঠিক কারণ অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজনে থানাভিত্তিক জরিপ প্রয়োজন। কোনো এলাকায় অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কারণ কী, সেটিও খুঁজে দেখা দরকার।