চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২৭ বছর আগে। ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনের সময় দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। নির্বাচনের ১০ মাস পর এরশাদের পতন হয়। এর পরের ২৬ বছরে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে চার দফা ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। কিন্তু এক বছর মেয়াদের চাকসু এখনো বহাল রয়েছে। চাকসুর নির্বাচিত সেই কমিটি এখনো বহাল রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন!
২৭ বছর আগে চাকসু নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) হন মো. নাজিম উদ্দিন। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সভা-সমাবেশে তাঁকে এখনো চাকসুর ভিপি হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়। তাঁর বয়স এখন ৫৮ বছর।
বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নাজিম উদ্দিন বলেন, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাকসু ভেঙে দেয়নি, তাই এখনো ভিপি তিনি। তাঁর কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান এখন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক।
নাজিম উদ্দিন বলেন, প্রতিবছর চাকসু নির্বাচন হলে ক্যাম্পাসে সংঘাত, হানাহানি এবং চাঁদাবাজির ঘটনা অনেক কমে যেত। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে শিক্ষার্থীরা যুক্ত হতে পারতেন। শিক্ষার্থীদের আবাসন, যাতায়াত, খাবার সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যার দ্রুত সমাধান করা যেত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাকসু নির্বাচন দিতে চায় না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের তিনতলা চাকসু ভবনের দেয়ালে লেখা রয়েছে ‘চাকসু আমার অধিকার’, ‘চাকসু নির্বাচনের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলুন’। বাম সংগঠনের পাশাপাশি ছাত্রলীগ, ছাত্রদলের নেতারাও চাকসু নির্বাচন চান। ছাত্রনেতাদের দাবি, চাকসু সক্রিয় থাকলে ছাত্রস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হবে তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচন দিচ্ছে না।
অবশ্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকে চাকসু নির্বাচন নিয়ে অযথা মাথা ঘামাতে চান না। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, চাকসু নির্বাচন আসলে হবে না। শুধু শুধু এ নিয়ে ভাবার কোনো মানে হয় না। চাকসু নির্বাচন নিয়ে ২০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁদের একজন লোকপ্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. নাদিম উল্লাহ। তিনি বলেন, চাকসু ভবনকে বেশির ভাগ ছাত্র চেনেন ক্যানটিন হিসেবে। তিনি মাঝেমধ্যে চাকসু ভবনের দোতলায় যান পত্রিকা পড়তে কিংবা টেবিল টেনিস খেলতে।
চাকসু নির্বাচনের দাবিতে চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় রেলস্টেশন চত্বরে মানববন্ধন করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। এর আগে ২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট চাকসু নির্বাচনসহ আট
দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে স্মারকলিপি দেয় ছাত্রলীগ।
তবে ছাত্রসংগঠনগুলো বারবার দাবি তুললেও এই মুহূর্তে চাকসু নির্বাচন দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানান উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার চমৎকার পরিবেশ বিরাজ করছে। নির্বাচন দিলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘাত, বিরোধ, হানাহানি এবং প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
উপাচার্য বলেন, ‘চাকসু নির্বাচনের আয়োজন করা হলে যদি কোনো ঘটনা ঘটে তার দায়দায়িত্ব ছাত্রসংগঠনগুলোকে নিতে হবে। তারা যদি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে এই গ্যারান্টি দেয় তাহলে নির্বাচন আয়োজনের চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে।’
২৭ বছর আগের চাকসু এখনো বহাল থাকার বিষয়ে উপাচার্য বলেন, এ ব্যাপারে খোঁজ নেবেন তিনি।
চাকসুর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি শিক্ষাবর্ষে একবার এই নির্বাচন হবে। মেয়াদ হবে এক বছর। ১৯ সদস্যের চাকসুর কমিটিতে উপাচার্য পদাধিকারবলে সভাপতি। কোষাধ্যক্ষ পদটি শিক্ষকদের মধ্য থেকে একজন মনোনীত করবেন উপাচার্য। বাকি ১৭টি পদ ছাত্রদের। তাঁরা ছাত্রদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন।
নির্বাচন না হলে চাকসুর পুরোনো কমিটি বহাল থাকবে কি না, সে বিষয়ে চাকসুর গঠনতন্ত্রে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাইলে চাকসুর কার্যক্রম স্থগিত করতে পারে। এমনকি চাকসুর নির্বাচিত কমিটিও ভেঙে দিতে পারে।
ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর আগে গত ২৭ বছরে আটজন শিক্ষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের কেউ চাকসু নির্বাচন দেওয়ার উদ্যোগ নেননি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ-১৯৭৩-এর ২২ ধারা অনুযায়ী, সিনেটের ১০১ সদস্যের ৫ জন হবেন ছাত্র প্রতিনিধি। কিন্তু চাকসু না থাকায় সিনেটে কোনো ছাত্র প্রতিনিধি নেই। ফলে ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়াই প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে সিনেট সভা।
১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রথম চাকসু নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে। ওই নির্বাচনে সহসভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে মো. ইব্রাহিম ও মো. আবদুর রব। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন আবদুর রব। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে ১৯৭১-৭২ এবং ১৯৭২-৭৩ সালে চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর জিয়াউর রহমানের আমলে দুবার এবং এরশাদের আমলে একবার নির্বাচন হয়। এরশাদের পতনের পর থেকে আর নির্বাচন হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে চাকসুর ভিপি ছিলেন আ ম শামসুজ্জামান। তিনি বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমেই দেশে সুস্থধারার রাজনীতির বিকাশ ঘটে। তাই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন।
চাকসুর আরেক সাবেক ভিপি ও ফটিকছড়ির সাবেক সাংসদ মজহারুল হক শাহ চৌধুরী বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার দায় মূলত সরকারের। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন সামরিক সরকারের আমলে যদি নির্বাচন হতে পারে, তাহলে গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে নির্বাচনে সমস্যা কোথায়।
নির্বাচন চায় ছাত্রসংগঠনগুলো
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় সব ছাত্রসংগঠনই চাকসু নির্বাচন চায়। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সভাপতি আলমগীর টিপু বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, কর্মকর্তা-কর্মচারী সমিতির নির্বাচন নির্দিষ্ট সময়ে হয়। কিন্তু যাঁদের কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়, সেই শিক্ষার্থীদের নির্বাচন না হওয়ার দায় প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এড়াতে পারেন না।
মারামারি, সহিংসতা ও সংঘাতের দোহাই দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বছরের পর ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রেখেছে বলে জানান ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচনেও মারামারি হয়। এরপরও এসব নির্বাচন ঠিক সময়েই হয় তাহলে চাকসু নির্বাচন কেন হবে না।
চাকসু নির্বাচনের পক্ষে থাকলেও সবার আগে ক্যাম্পাস এবং হলে সহাবস্থান নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম।
২৭ বছর আগে অনুষ্ঠিত চাকসু নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন বর্তমানে ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করা মুহাম্মদ সিকান্দার খান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেন, চাকসু নির্বাচনের আয়োজন করা উপাচার্যের দায়িত্বের অংশ। বিভিন্ন সরকার আইন না মেনে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছে। ফলে উপাচার্যরা ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে কখনো উদ্যোগী হন না।