‘রেহান তো খুবই নরম প্রকৃতির মানুষ। আমার মনে হয় না ওর কোনো রাগ আছে। রাগ থাকলে আমার আছে।’ ২০১১ সালে দ্বিতীয় বিয়ের চতুর্থ দিন প্রথম আলোকে এমনটাই বলেছিলেন হাবিব। বিবাহবিচ্ছেদের পর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই গায়ক ও সংগীত পরিচালক বলেন, ‘দেখুন, দুজন মানুষের মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে ভালো লাগা, ভালোবাসা কাজ করে। আবার কিছু বিষয়ের সমাধান হয় না। তেমন কিছুই আমাদের মধ্যে হয়েছে। এ কারণে আলাদা হয়ে গেছি।’ কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের শোবিজে বিবাহবিচ্ছেদের খবর যেন খুব মামুলি ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে হারে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটছে, তাতে দেশের সাধারণ মানুষও তারকাদের নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছেন। অনেকের মতে, বিয়েটা বেশির ভাগ তারকার কাছে ছেলেখেলা হয়ে গেছে।
অমুক তারকার বিয়ে আজ, তো কাল ওই তারকার ছাড়াছাড়ি! এসব নিয়ে ভক্ত-দর্শকের মাঝে কাদা ছোড়াছুড়ি তো চলেই। তাই কোনো তারকার বিয়ে হলে ভক্তরা প্রার্থনা করেন, যেন সুখে-শান্তিতে বাস করতে পারেন। ভাঙনের বিষয়টা এখন এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে, বিবাহবিচ্ছেদটা যেন অন্তত শান্তিতে হয়, সেই প্রার্থনাই করেন তাঁরা! এ বছর শোবিজের অনেক জনপ্রিয় তারকার সংসার ভেঙেছে। বলা যেতে পারে, বছরটা তারকাদের ঘর ভাঙার বছর হিসেবেই বেশি আলোচিত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারিবিলিটি স্টাডিজ বিভাগের পরিচালক ও সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্যান্য দেশেও তারকাদের বিয়ে আর বিচ্ছেদ নিয়ে বেশি আলোচনা হয়। সাধারণ মানুষ আলোচনায় আসে না। বিবাহবিচ্ছেদের কারণগুলো এতে জড়িত ব্যক্তিরাই ভালো জানবেন। তারকাদের বিবাহবিচ্ছেদে নেতিবাচক প্রভাব সমাজে পড়ে। বাংলাদেশ এখনো পারিবারিক আবহের বাইরে না। যখন সমস্যাগুলো তৈরি হয়, তখন পরিবার আর বন্ধুদের নিয়ে মিটিয়ে ফেলা যায়। তাহলে কিন্তু ঘটনা এত দূর পর্যন্ত যায় না।’
তারকাদের কেউ বিয়ের পর আবার কেউবা মা-বাবা হওয়ার পরও বিবাহবিচ্ছেদের পথে হাঁটেন। সন্তান জন্মের পর বিচ্ছেদ সেই সন্তানের মানসিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কারণ, বিচ্ছেদের ফলে এসব সন্তান মা-বাবা থেকে আলাদা হয়ে যায়। মাহবুবা নাসরীন বলেন, ‘আমাদের শিশুরা কিন্তু মা-বাবাকে আলাদা দেখে অভ্যস্ত না। যেসব দেশে দেখে অভ্যস্ত, সেসব দেশে শিশুদের দায়িত্ব কিন্তু রাষ্ট্র নিয়ে নেয়। সেসব শিশু অনেক নিরাপত্তা পায়। আমাদের এখানে তো সে ব্যবস্থা নেই। এই ধরনের বিবাহবিচ্ছেদ পরিবার ও পুরো সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।’
মতের অমিলে বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া তারকারা কয়েক মাস যেতে না যেতেই আবার বিয়ে করে বসেন। কারণ, কেউই আসলে সঙ্গীহীন থাকতে পারেন না। সম্প্রতি তৃতীয় বিয়ে করলেন গায়ক ও সংগীত পরিচালক হৃদয় খান। মাহবুবা নাসরীন বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায়, ছেলেমেয়ে উভয়েই একজীবনে অনেক কিছুতে সমঝোতা মেনে নেয়নি, কিন্তু দ্বিতীয় জীবনে প্রবেশ করার পর মনে করে, এই সমঝোতা যদি আগে করতাম, তাহলে বিয়েটা ধরে রাখতে পারতাম। তখন আরও জটিলতা তৈরি হয়। তবে যেসব ক্ষেত্রে নির্যাতনের হার বেশি, সে ক্ষেত্রে কোনোভাবেই বলব না যে মা-বাবা একসঙ্গে থাকুক। আর যদি শিশু থাকে, শিশুর সামনে একটা অসুখী মা-বাবা থাকে, তাহলে ওই শিশুর মনে চাপ পড়ে।’
সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন বিয়ের শুরুতে স্বামী-স্ত্রীকে সমঝোতার মানসিকতা বজায় রাখার পরামর্শ দিলেন। বললেন, ‘সমঝোতার জায়গাটা প্রথমেই ঠিক করা উচিত। আরেকটা কথা, আমাদের অনেকেই বিয়ের আগের জীবন আর পরের জীবন তুলনা করি। এই তুলনাটাও কিন্তু অনেক সময় ঝামেলা বাড়িয়ে দেয়। সমস্যা হলে কাউন্সেলরের পরামর্শ যেন নেওয়া হয়। আগে পরিবার আর বন্ধুরা কাউন্সেলরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। এখন তো মুঠোফোন ছাড়া কোনো বন্ধু নেই। এই মুঠোফোনের কারণে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কারও কথা বলার সময় থাকে না। একাকিত্বর ব্যাপারটা অনেক বেশি কাজ করে। বিবাহবিচ্ছেদ ঠেকাতে দম্পতিদের কাউন্সেলিংয়ের অনেক সফলতা আছে।’
১০ বছরের প্রেমের পর এ বছর মে মাসে বৈমানিক পারভেজ সানজারিকে বিয়ে করেন পপ গায়িকা মিলা। ওই সময় মিলা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘ওর (সানজারি) সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম থেকে বুঝতে পেরেছি, সে-ই আমাকে সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারবে। পথচলার সঙ্গী হিসেবে তাঁকে আমার সেরা মনে হয়েছে। আমি একটু চঞ্চল প্রকৃতির। আর ও তো খুবই শান্ত। স্বভাবের এ বৈপরীত্যের কারণে নিজেদের সমন্বয়ও হয়ে যায়।’ সপ্তাহ খানেক আগে এই গায়িকা জানান, বিয়ের ১৩ দিনের মাথায় নাকি তাঁদের সংসারে অশান্তি শুরু হয়। শান্ত প্রকৃতির স্বামী তাঁর কাছে অশান্ত হয়ে দেখা দেয়। শুধু কি তা-ই, মিলার মামলায় এখন জেলহাজতে দিন কাটাতে হচ্ছে বৈমানিক স্বামীকে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘শোবিজের মানুষেরা সাধারণত আবেগপ্রবণ। মানুষের তো দুটি সত্তা থাকে—একটা আবেগী, অন্যটা যৌক্তিক। একজন মানুষের জীবনে দুটোরই প্রয়োজন আছে। কিন্তু আবেগী সত্তাটা যাদের বেশি, তাঁরা অনেক বেশি সৃজনশীল হন, যেকোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও আবেগটাকে প্রাধান্য দেন।’
সংসারে অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয়। সাধারণ মানুষ যতটুকু মানিয়ে নিতে পারেন, তারকারা তা পারেন না উল্লেখ করেন তাজুল ইসলাম বলেন, ‘তারকারা বিয়ের বাইরে প্রেম করতে খুব ভালো পারে। বিয়ের পর একজন মানুষের মধ্যে দায়বদ্ধতা, বিশ্বাস, ভালোবাসা, কম্প্রোমাইজ—এসব দেখা দেয়। কিন্তু অনেক তারকার মধ্যে এই ব্যাপারগুলোর ঘাটতি থাকে। বাস্তব জীবনে মানুষ যে অন্য রকম, এটা তাদের অনেকরই উপলব্ধিতে থাকে না। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই তাদের মুগ্ধতা ও মোহ ভেঙে যায়।’
তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘অনেকের সঙ্গে চলতে হয়। তারকারা মুক্ত জীবন যাপন করে। সাধারণ মানুষের যেমন সংসার করার একটা বাধ্যবাধকতা থাকে, তাদের মধ্যে তা থাকে না। সংসারটা করতেই হবে—এই ব্যাপারে তাদের একটা শিথিলতা আছে। আর্থিক ও সামাজিকভাবে বাধ্যবাধকতা থাকে না যে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হবে। তারা অনেক কিছু উপলব্ধি করতে পারে না।’
শুধু তারকারা নয়, সাধারণ মানুষের জীবনেও অনেক চড়াই-উতরাই থাকবে। এর মধ্যে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা বড় সার্থকতা। কারণ, ভাঙন সব সময় একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাজুল ইসলাম বলেন, ‘সাধারণ মানুষ তারকাদের আদর্শ মানে। তাদের লাইফস্টাইল ভক্তরা অনুসরণ করে, কারণ তারকাদের তারা আদর্শ মানে।’
তাজুল ইসলামের পরামর্শ, বিয়ে বিষয়টা হচ্ছে কমিটমেন্ট। একই সঙ্গে এই সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্যতা আর ভালোবাসাও থাকতে হবে। শুধু ভালোবাসায় সংসার টেকে না। তাজুল ইসলামের পরামর্শ, ‘মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে। নিজের মধ্য সমঝোতা, পরস্পরকে সম্মান, সংসারের স্থায়ী কাঠামোর ব্যাপারও ভাবতে হবে।’
তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘মানুষ যে বড় হলেই ম্যাচিউরড হয়, তা কিন্তু নয়। টাকা-পয়সা কিংবা খ্যাতির কারণে দৌড়াতে গিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারকারা মানবীয় গুণাবলি ও পারিবারিক মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যায়।’
সাধারণ মানুষ সংসার ত্যাগ করে না কেন? তাজুল ইসলাম বলেন, ‘সাধারণ মানুষের কাছে সংসার ত্যাগ করা সামাজিক লজ্জা, এটা অনেক ক্ষেত্রেই তারকাদের মধ্যে নেই। বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়স্বজন বাধা দেয়। তারকাদের আত্মীয়স্বজন থেকেও নেই, তাঁদের কেউ বাধা দেয় না। বিবেচনাগুলো কাজ করে না।’
চারদিকে হরহামেশা বিচ্ছেদের খবর যেমন তারকাদের ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের মনে নেতিবাচক ধারণা দেয় আর আতঙ্কিত করে, ঠিক তেমনি কিছু জুটি ভক্তদের আশাবাদীও করে তোলে। শুধু তা-ই নয়, তারকাদের কাছেও তাঁরা আদর্শ। তাঁদের মধ্যে অন্যতম সৈয়দ হাসান ইমাম ও লায়লা হাসান দম্পতি। ৫৩ বছরের পথচলা তাঁদের। দীর্ঘ বিবাহিত জীবন নির্বিঘ্নে কাটিয়ে দেওয়ার মূলমন্ত্র কী, জানতে চাইলে লায়লা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে দুজনের মানসিকতার মিল, বিশ্বাস আর শ্রদ্ধাবোধ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বয়সে আমি তার (সৈয়দ হাসান ইমামের) থেকে প্রায় ১২ বছরের ছোট। কিন্তু বয়সে ছোট বলে আমাকে সে কখনোই অসম্মান করেনি। স্বামী আমাকে সম্মান দিয়েছে বলেই সন্তান আর শ্বশুরবাড়ির সবার কাছ থেকেও আমি অনেক সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছি।’
এই প্রজন্মের দম্পতিদের সুখী থাকার একটি কৌশলও বাতলে দিলেন লায়লা হাসান। তাঁর মতে, ধৈর্য আর সহনশীলতাই সংসারজীবনে সুখী থাকার আসল চাবিকাঠি। পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যকার ঝামেলাগুলো মিটিয়ে ফেলারও পরামর্শ দেন তিনি। নিজেদের মধ্যে যদি টুকটাক ঝামেলা হয়, তাহলে তা যেন নিজেরাই মিটিয়ে ফেলেন। আর বাদ দিতে বললেন অহংবোধ।
গত কয়েক মাসে যে কয়েকটি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা শোবিজ অঙ্গনে ঘটেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন তাহসান ও মিথিলা। কারণ, ভক্তদের পাশাপাশি এই দম্পতি তারকাদের আদর্শ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে পেরেছিলেন। তাহসান ও মিথিলার বিবাহবিচ্ছেদ তাঁদের ভক্ত-শ্রোতাদের কষ্টের সাগরে ভাসিয়েছে। বহু বিবাহবিচ্ছেদ মেনে নিতে পারলেও এটি তাঁরা মেনে নিতে পারেননি।
গত কয়েক মাসে শোবিজে যে কয়েকটি বিবাহ বিচ্ছেদের খবর পাওয়া গেছে, তার মধ্যে আছেন হাবিব-রেহান, তাহসান-মিথিলা, শখ-নিলয়, বাঁধন-সনেট, নোভা-রায়হান, হৃদয় খান-সুজানা, মিলা-পারভেজ সানজারি, স্পর্শিয়া-রাফসান।
সন্দেহ, অবিশ্বাস আর পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থার অভাবে মূলত সংসারে ভাঙন দেখা দেয়। ভাঙনের পর আবার অনেকে নতুন করে সংসার শুরু করেন। কারও সে সংসার টেকে না। মনে রাখতে হবে, তারকা শিল্পীরা সব ক্ষেত্রে মানুষের আদর্শ নন। কারও গান, কারও অভিনয় কিংবা সিনেমা বানানোর দক্ষতা ভালো লাগতে পারে। কিন্তু প্রত্যেকের ব্যক্তিজীবন আলাদা। যেকোনো ব্যক্তির সংসার ভেঙে যাওয়া বেদনাদায়ক।