ঢাকার বড় সাতটি কলেজের অধিভুক্তি নিয়ে গত আট মাসেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বন্দ্ব কাটেনি। এই দ্বন্দ্বের কারণে খেসারত দিতে হচ্ছে এসব কলেজের দেড় লাখের বেশি শিক্ষার্থীকে। স্নাতক (সম্মান) চতুর্থ বর্ষের ফল প্রকাশসহ পাঁচ দফা দাবিতে গতকাল রোববারও রাজধানীর নীলক্ষেত-নিউমার্কেট মোড়ে দিনভর বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এর ফলে তীব্র যানজটে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। দুর্ভোগে পড়ে মানুষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসার পর এই সাত কলেজের পরীক্ষা ও ফল প্রকাশ নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হয়। পরীক্ষার সময়সূচি (রুটিন) না দেওয়ায় গত জুলাই মাসে শিক্ষার্থীরা প্রথম দফায় আন্দোলনে নামেন। গত ২০ জুলাই পরীক্ষার রুটিনসহ পাঁচ দফা দাবিতে শাহবাগে বিক্ষোভের সময় পুলিশের ছোড়া কাদানে গ্যাসের শেলে চোখ হারান তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান।
দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা এবং এসব কলেজের একাধিক অধ্যক্ষ বলছেন, এসব কলেজ হাতছাড়ার ‘ক্ষোভে’ শুরু থেকেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে অসহযোগিতা করছে। আবার এই মুহূর্তে বিপুলসংখ্যক কলেজশিক্ষার্থীর ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পর্যাপ্ত জনবলও নেই। আর এসব জটিলতা তৈরির পেছনে কাজ করেছে দুই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ‘আত্মসম্মানবোধের সমস্যা’।
মূলত এসব জটিলতার পেছনে ঘুরেফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্যবিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদের প্রকট দ্বন্দ্ব কাজ করেছে বলে মনে করেন সাত কলেজের একাধিক অধ্যক্ষ। তবে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যের সঙ্গে অধ্যাপক হারুনের সুসম্পর্ক থাকায় এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চতুর্থ বর্ষের ফল তৈরিতে সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় দ্রুত এই ফল প্রকাশ করা হবে।
গত ফেব্রুয়ারিতে ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) চতুর্থ বর্ষের লিখিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার মুহূর্তে ঢাকার এই সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। কিন্তু তখনো বাকি থাকে চতুর্থ বর্ষের মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষা। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও ফল আটকে থাকে। এর মধ্যে গত মে মাসে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর ফল প্রকাশ হয়ে গেলে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
অভিযোগ রয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই সাত কলেজের লিখিত পরীক্ষার তথ্যসহ অন্যান্য বর্ষের ফলাফলের তথ্য দিতে গড়িমসি করে। কিন্তু স্নাতকের চূড়ান্ত ফল তৈরি হয় প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের ফলের সমন্বয়ের ভিত্তিতে। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে সব তথ্য সময়মতো পায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গতকাল বলেন, কিছু কিছু তথ্য পেলেও প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য এখনো বাকি আছে।
একটি কলেজের অধ্যক্ষও বলেন, দেখে শুনে মনে হচ্ছে সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাওয়াটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ অসহযোগিতার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বাস্তবতা হলো কলেজগুলোর ফল তৈরি যে জটিল প্রক্রিয়ায় হয়, তা এই মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে করলে দীর্ঘ সময় লাগবে। এ জন্য তিনি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যকে বলেছেন, শিক্ষার্থীদের স্বার্থে তাঁরা ফল তৈরি করে দিতে প্রস্তুত আছেন।
তিতুমীর কলেজের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিংয়ের ছাত্র শরিফ হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে তাঁরা কেন খেসারত দেবেন? তাঁরা চান দ্রুত ফল প্রকাশ হোক। কারণ চতুর্থ বর্ষ শেষ করতেই তাঁদের ছয় বছর চার মাস চলে গেছে।
অবশ্য ওই সাত কলেজের একাধিক ছাত্র ও শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষার কার্যক্রমটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শেষ করে বাদবাকি কার্যক্রম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিলে এই সমস্যা এত দূর গড়াত না।
২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাপ কমাতে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি কলেজগুলোকে সংশ্লিষ্ট এলাকার সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা ঢাকার বড় সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। কলেজগুলো হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। ওই সময় এসব কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ১ লাখ ৬৭ হাজার ২৩৬ জন শিক্ষার্থী ও ১ হাজার ১৪৯ জন শিক্ষক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসার পর পরীক্ষা ও ফল প্রকাশ নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হয়।