নোবেল ঘোষণা হলে সব সময়ই কিছু না কিছু বিতর্ক হয়। সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয় সম্ভবত সাহিত্য কিংবা শান্তি পুরস্কার নিয়ে। এই দুই শাখায় কে নোবেল পাচ্ছে, এ নিয়ে সাধারণের আগ্রহ থাকে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক বেশ পুরোনো। এর পেছনে রাজনীতিও খুঁজে পান অনেকে।
বিতর্ক
রাশিয়ার কবি ও লেখক বরিস পাস্তারনাক নোবেল পুরস্কার জেতেন ১৯৫৮ সালে। কিন্তু তখনকার সোভিয়েত সরকারের চাপে পড়ে এ পুরস্কার বিসর্জনের ঘোষণা দিতে হয়েছিল। অন্যদিকে ১৯৬৪ সালে নোবেল বিজয়ী ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্রে কখনো ইচ্ছাই করেননি নোবেল জেতার! ফেলে আসা জীবনে নিয়মিতভাবে সব আনুষ্ঠানিক সম্মান প্রত্যাখ্যানকারী সার্ত্রে নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে এই অপারগতাকেই তুলে ধরেছিলেন সবার সামনে। তবে নোবেল কমিটি তাঁদের দুজনের নাম নোবেলজয়ী তালিকা থেকে বাদ দেয়নি।
অন্যদিকে ১৯৭৪ সালে যুগ্মভাবে নোবেল পুরস্কার জিতে তৃপ্তির হাসি হেসেছেন স্বল্পপরিচিত সাহিত্যিক এইভিন্দ ইয়োনসন ও হ্যারি মারটিনসন, যাঁরা কিনা প্রত্যক্ষভাবে নোবেল একাডেমির সদস্য ছিলেন! পুরস্কারটি জয়ে তাঁরা পেছনে ফেলেছেন গ্রাহাম গ্রিনি, সল বেলো ও ভ্লাদিমির নাবোকভদের মতো সাহিত্যিকদের। এ তো অনেকটা নিজেই নিজেকে পুরস্কার দেওয়া!
১৯৮৯ সালে বেশ সমালোচনার ঝড় ওঠে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের নিয়মনীতি নিয়ে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদি কিংবা আমেরিকান নাট্যকার আর্থার মিলার নোবেল জিততে পারেন বলে বেশ আলোচনার জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববাসীর ভাবনা-চিন্তার পথে হাঁটেনি নোবেল কমিটি। এ দুজনকে নোবেল জয়ে যোগ্য মনে না করার পেছনে নোবেল কমিটি ব্যাখ্যা দিয়েছিল, তাঁরা বেশ আলোচিত এবং একটু বেশিই জনপ্রিয়! নিজের কাজ দিয়ে বেশি পরিচিত হয়ে গেলে আবার বিপদ! নোবেল জুটবে না কপালে!
গেল বছরই তো বেশ চমকে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটল, যখন কিংবদন্তি গায়ক বব ডিলানের নাম সাহিত্যে নোবেলজয়ীর তালিকায় উঠে আসে! ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়া ডিলান সপ্তাহখানেক নিশ্চুপ ছিলেন এই অপ্রত্যাশিত জয়ে। শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি গ্রহণ করেছিলেন বটে, তবে সেটা মূল অনুষ্ঠানে না গিয়ে।
বিখ্যাত কিংবা হারিয়ে যাওয়া সাহিত্যিকেরা…
আমেরিকান লেখক উইলিয়াম ফকনার (১৯৪৯), আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৯৫৪), জন স্টেইনবেক (১৯৬২), ফরাসি লেখক আঁন্দ্রে জিদ (১৯৪৭) এবং আলবেয়ার কামুর (১৯৫৭) মতো যোগ্য এবং জগদ্বিখ্যাত লেখকদের নোবেল পুরস্কারে পুরস্কৃত করার নজিরও রেখেছে সুইডিশ নোবেল কমিটি। বিতর্কের অপবাদ ঘোচাতে বাদ পড়েননি স্যামুয়েল বেকেট (১৯৬৯) কিংবা গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ (১৯৮২)।
কিন্তু সাহিত্যে অতুলনীয় অবদান রাখার পরও নোবেলের খাতা থেকে বাদ পড়ে গেছেন অনেক যোগ্য লেখক। জোসেফ কনরাড, জেমস জয়েস, মার্সেল প্রুস্ত, পল ভ্যালেরি, হেনরি জেমস ও ভার্জিনিয়া উলফদের নাম খোদাই হয়নি নোবেল খেরোখাতায়, থেকে গেছে কেবল মানুষের অন্তরেই।
যেখানে হারিয়ে গেছেন সত্যিকারের যোগ্য সম্ভাব্য বিজয়ীরা, সেখানে নোবেল কমিটি সাহিত্যের মুকুট পরিয়েছে অপ্রচলিত লেখকদের মাথায়, যাঁরা নিজেদের দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছাতে পারেননি বিশ্ববাসীর কাছে। সেসব সৌভাগ্যবান বিজয়ীর মধ্যে আছেন আইসল্যান্ডের লেখক হল্ডর ল্যাক্সনেস (১৯৫৫), এরিক অ্যাক্সেল কার্লফেল্ট (১৯৩১), অদিসেস এলিতিস (১৯৭৯) ও জারোসাল্ভ সেইফার্ট (১৯৮৪)।
এ-যাবৎকালে সাহিত্যে সর্বমোট ১৪ জন নারী নোবেল বিজয়ীর নাম এসেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ১৯০১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর নোবেল পুরস্কার দেওয়ার তালিকায় মাত্র ছয়জন নারী লেখক ছিলেন।
পশ্চিমা রাজত্ব!
১৯০১ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত মাত্র আটজন নোবেল বিজয়ী ছিলেন, যাঁরা ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সীমানার বাইরের মানুষ! আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে প্রথম বাঙালি হিসেবেই শুধু নন, প্রথম এশীয় হিসেবে নোবেল জেতেন। মিসরীয় লেখক নাগিব মাহফুজ ১৯৮৮ সালে প্রথম ও একমাত্র আরব লেখক হিসেবে জিতেছিলেন নোবেল পুরস্কার।
পশ্চিমাদের বাইরে নোবেল বিজয়ের এই ধারাবাহিকতায় আছেন আফ্রিকা থেকে একমাত্র নোবেল বিজেতা নাইজেরিয়ার ওলে সোয়িংকা (১৯৮৬), চীন থেকে গাও জিনজিয়ান (২০০০) ও তুরস্ক থেকে ওরহান পামুক (২০০৬)।
১৯৮৫-এর আগে নোবেল জয়ে পূর্ব-পশ্চিম বৈষম্যের নেপথ্যে একটা কারণ হতে পারে—তখন অনুবাদের এত সুযোগ-সুবিধা ছিল না, আর তাই বিচার-বিশ্লেষণেও নোবেল কমিটির বেশ সমস্যা হতো অন্য ভাষার সাহিত্য বুঝে নিতে। কিন্তু মোটের ওপর নোবেলে এখনো পশ্চিমাদেরই রাজত্ব।
ভূরাজনীতি!
নোবেল কমিটির রীতি অনুযায়ী, যেসব সাহিত্যিক নিজ ভূখণ্ডে নির্বাসিত, ভিন্নমতাবলম্বী কিংবা মূল পন্থার পরিপন্থী তাঁদের উৎসাহিত করা দায়িত্বের অংশ। সে রীতি অনুযায়ী সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন গুয়াতেমালার লেখক মিগেল অ্যাঞ্জেল আস্তুরিয়াস (১৯৬৭) আর বিশ্বখ্যাত চিলিয়ান কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা (১৯৭১)। অর্থাৎ, এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মানুষটির অবদান তখন একমাত্র বিবেচ্য থাকে না। এ কারণে সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল কখনো কখনো উসকে দেয় বিতর্ক।