‘থাব্বেদের’ ওপর রোহিঙ্গাদের যত ক্ষোভ

Slider সারাবিশ্ব

d61dac278215a5635d69813f7c2366c2-59c646680934c

 

 

 

 

কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে এসে উঠেছেন নূর আলম। তাঁর যত ক্ষোভ ইব্রাহীম নামের এক ব্যক্তির ওপর। মিয়ানমারের মংডুর শিলখালিতে থেকে এই ইব্রাহীমই দেশছাড়া করেছে নূর আলমসহ আরও বহু মানুষকে। আঞ্চলিক ভাষায় ইব্রাহীমের মতো ব্যক্তিদের রোহিঙ্গারা ‘থাব্বে’ বলেন। দালাল বা বেইমান বোঝাতে থাব্বে শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় নূর আলম যখন ইব্রাহীমের কথা বলছিলেন, তখন শিবিরের আরও অনেকে তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। প্রায় প্রত্যেকের গ্রামেই সেনাবাহিনী, উগ্রবাদী রাখাইনদের মতো উৎপাত ছিল এই থাব্বেদের। এঁরা নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে স্থানীয় রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে সেনাবাহিনী বা সরকারকে তথ্য দিতেন। থাব্বেরা নিজেরা রোহিঙ্গা হওয়া সত্ত্বেও স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে অন্য রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ, হত্যায় সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছেন।
পালিয়ে বাংলাদেশে আসা শিলখালির কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ইব্রাহীমের উত্থান আশির দশকে। মিয়ানমারে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে পরিচিত রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্য ছিলেন তিনি। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বান্দরবানেই বেশি থাকতেন বলে শুনেছেন এলাকার লোকজন। নব্বই দশকে এসে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর এলাকায় তাঁর উৎপাত শুরু হয়। সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের দালাল হয়ে কাজ শুরু করেন।
এ কাজের কারণে ইব্রাহীম কি কিছু পেয়েছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে নূর আলম বলেন, সরকার রোহিঙ্গাদের জমি কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু ইব্রাহীম ১০ কানি জমি পেয়েছেন, চিংড়ির প্রকল্প পেয়েছেন, সরকার তাঁর বাড়ি করে দিয়েছে।
মংডুর পোয়াংখালির হুক্কাটা (চেয়ারম্যান) আবুল ফাইজুল বলছিলেন, গত বছরের অক্টোবরে তাঁদের গ্রাম সেনাবাহিনী ঘিরে ফেলে। তখন এক থাব্বে তাঁর হাতে চিরকুট পাঠিয়ে বলে, সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাঁকে খুঁজছেন। তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখেন কয়েক শ পুরুষকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলা হয়েছে। তাদের চোখ স্কচটেপ দিয়ে বাঁধা। আর পাশেই তিনজন নারীর মৃতদেহ পড়ে আছে।
ফাইলুজ এলাকায় যে প্রভাবশালী, সেনাসদস্যদের কাছে আগেই সে খবর দিয়েছিল থাব্বেরা। তাঁকে সেদিন দুপুরে সেনাবাহিনীর জন্য খাবারের আয়োজন করতে বলা হয়। প্রাণভয়ে তিনি গরু জবাই করে ভাত খাওয়ান সেনাসদস্যদের। খাওয়াদাওয়ার পর গ্রামের ৫০ জন সুন্দরী নারী জোগাড় করে দিতে বলেন সেনাসদস্যরা। এ ঘটনার পর কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসেন তিনি।
কথার ফাঁকে এক তরুণ বলে বসেন, রাখাইনে অনেকে আছেন যাঁরা শুধু বেঁচে থাকার জন্যই থাব্বেরের কাজ করেছেন। এক তরুণ বলেন, তিনি গাড়ি চালাতেন। সেনাসদস্যরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য তাঁকে গাড়ি চালাতে বাধ্য করতেন। তাঁর চোখের সামনেই অনেক নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। তিনি কিছুই করতে পারেননি।
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই থাব্বেরা বেশ আরাম-আয়েশে থেকেছেন। আর নিজেদের পরিচত-অপরিচিত রোহিঙ্গাদের বিপদে ফেলেছেন। তবে এ বছর ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যখন রোহিঙ্গা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে মাঠে নামে, তখন থেকে থাব্বেদের অবস্থাও অন্য রোহিঙ্গাদের মতো হতে থাকে।
নূর আহম্মেদ নামে মংডুর বলিরবাজারের এক বাসিন্দা বলেন, তাঁদের এলাকায় মাহাতু নামে এক থাব্বেরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন তাঁরা। এই দফায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের সময় মাহাতুকে ক্যাম্পে ডেকে পাঠানো হয়। এরপর থেকে তার হদিস আর কেউ বলতে পারেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *