মা হারানোর শোক নিয়েই সাফ জয়ের পণ

Slider খেলা

0562c6522d2d8bd5ad6adb1379f1390e-59c6137cde92f

 

 

 

 

 

 

 

ছেলে ফুটবল খেলতে মাঠে গেলেই জায়নামাজে বসে থাকতেন মা। দুই হাত তুলে দোয়া করতেন ছেলের জন্য। সে যেন ভালো খেলে। সুস্থ শরীর আর জয় নিয়ে যেন সে ফিরতে পারে। কিন্তু ছেলে যখন দেশের জার্সিতে বিদেশের মাটিতে খেলছে, জিতছে, দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে, তখন মা নেই। তবে কোনো দূরলোক থেকে নিশ্চয়ই তিনি ছেলের খেলা দেখছেন। আশীর্বাদ করছেন তাঁকে।

ভুটানের থিম্পুতে অনুষ্ঠানরত সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ ফুটবলে বাংলাদেশ যুব দল শিরোপা জয়ের স্বপ্ন দেখছে। মনির আলম সেই দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। কিন্তু তার মা পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন মাত্র তিন সপ্তাহ হয়েছে। মাকে হারানোর শোক ভুলেই মনির এখন ব্যস্ত দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। নিজের ফুটবলজীবনের সঙ্গে যে মা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে, সেই মাকে ছাড়া মনিরের সময়টা কতটা কষ্টের, সেটি অনুধাবন করাটা খুব কঠিন কিছু নয়।

যুব দলের ক্যাম্প থাকায় গত ঈদুল আজহায় বাড়ি যাওয়া হয়নি মনিরের। ঈদের আগে কথাও হয়েছে মায়ের সঙ্গে। কিন্তু ঈদের পরদিনই ক্যাম্পে বসে তাকে শুনতে হয়েছে ভয়াবহ দুঃসংবাদটি। হঠাৎ করেই মা তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। শোকবিহ্বল মনির সেই কষ্ট চেপেই এখন যুব দলের হয়ে খেলছে ভুটানে। মায়ের মুখটা মনে হলেই কষ্টটা বেরিয়ে আসে অশ্রু হয়ে। কিন্তু পরক্ষণেই চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় কষ্ট চাপে সে—দেশের জার্সিতে ছেলেকে দেখার স্বপ্নটা যে মায়েরও ছিল। দেশকে ভালো কিছু দেওয়ার অভিপ্রায়ে তখন ব্যক্তিগত কষ্টকে চাপা দিয়ে দিতে হয়। কিন্তু ১৮ বছরের মনিরের কষ্টটা ঠিকই বোঝা যায় চোখে চোখ রাখলে। মা হারানোর কষ্টটা তো সে-ই বোঝে, যে মাকে হারিয়েছে।

আট ভাইবোনের মধ্যে মনিরই সবার ছোট। মা দেলোয়ারা খাতুন স্বপ্ন দেখতেন ছোট ছেলেটা একদিন মস্ত বড় ফুটবলার হবে। প্রিমিয়ার লিগে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে জায়গা করে নেওয়া পর ছেলে এখন জাতীয় যুব দলে। মা নেই, কিন্তু তিনি ছেলের মনে ঠিকই গেঁথে দিয়ে গিয়েছেন স্বপ্নটা। সে স্বপ্নই সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে মনিরের অনুপ্রেরণা, ‘ছোটবেলা থেকে ফুটবল খেলার জন্য মা-ই আমাকে সহযোগিতা করত। আমাকে নিয়ে তার স্বপ্ন ছিল আমি বড় ফুটবলার হব। মায়ের স্বপ্নটা আমাকে পূরণ করতেই হবে।’

হোটেলের লবিতে বসে মনির মায়ের স্বপ্ন শুনিয়ে যায়, কিন্তু চোখের জলটা কোনোভাবেই লুকাতে পারে না। মায়ের মৃত্যুটা এতটাই আকস্মিক যে মায়ের স্পর্শ যেন এখনো পায় মনির। সারাক্ষণ মনে হয়, মা যেন তাঁর পাশেই আছেন, ‘কী বলব! ঈদের দিন রাত নয়টায় মায়ের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছে ফোনে। মা জিজ্ঞেস করলেন কোরবানির মাংস খাওয়ার কোনো বন্দোবস্ত জাতীয় যুব দলের ক্যাম্পে আছে কি না। সে মা-ই আমার চলে গেলেন রাত বারোটার দিকে। একেবারে হঠাৎ করেই।’

মনিরের মা দেলোয়ারা খাতুনের মৃত্যুর সংবাদ ছুঁয়ে গিয়েছিল গোটা দলকেই। একজন সতীর্থের জীবনের এই দুর্ঘটনায় ভেঙে পড়েছিল সবাই। কিন্তু মনিরের মাথায় হাত রেখে সবাই প্রতিজ্ঞা করেছে, অন্তত এই মানুষটির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই টুর্নামেন্টে ভালো খেলার।

নিজেদের প্রথম ম্যাচে প্রথমার্ধেই ভারতের বিপক্ষে ৩-০ গোলে পিছিয়ে যায় বাংলাদেশ। পরে পাল্টা চার গোল দিয়ে তুলে নেয় অবিশ্বাস্য এক জয়। সে ম্যাচের বিরতিতে বাংলাদেশ কোচ মাহবুব হোসেন রক্সি যে কয়টি নতুন কৌশল নিয়েছিলেন, তার অন্যতম হচ্ছে মনিরকে মাঠে নামানো। রাইট ব্যাক মনিরের সহজাত বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে তিনি চেপে ধরতে চেয়েছিলেন শক্তিশালী ভারতকে।

মনিরের সেই দায়িত্বটা দারুণভাবে পালন করেছে। দ্রুত ওভারল্যাপ করে উঠে বারবার ভেঙেছে ভারতের ডিফেন্স। সে ম্যাচের ৪-৩ স্কোরলাইনটা দেশের ফুটবল ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা।

পরের ম্যাচটাও বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৮ দল জিতেছে হেসেখেলেই। মালদ্বীপকে হারিয়েছে ২-০ গোলে। যে ভারত, মালদ্বীপ এখন সাফ অঞ্চলেই ফুটবল পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত, যে ভারত-মালদ্বীপকে বহু বছর হারাতে পারে না বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দল, সেই দলগুলোকেই উড়িয়ে দিয়ে মনিরদের যুব দল আবারও স্বপ্ন দেখাচ্ছে ফুটবলপ্রেমীদের। থিম্পুর বড় বড় পাহাড়ও জানে, অনূর্ধ্ব-১৮ ফুটবলে শিরোপার সবচেয়ে বড় দাবিদার এখন বাংলাদেশ। বাধা হিসেবে সামনে দুই প্রতিপক্ষ—নেপাল ও ভুটান। একটি জয় ও একটি ড্রতেই হাতের মুঠোয় চলে আসবে শিরোপা।

শিরোপাটি নিয়ে যে বাংলাদেশে ফিরতেই হবে। বন্ধুরা কথা দিয়েছে মায়ের শোক বয়ে চলা মনিরকে। আর মনির কথা দিয়েছে তার মাকে! অচেনা ভুবন থেকে মনিরের স্নেহময়ী মা নিশ্চয়ই আশীর্বাদ করে যাচ্ছেন গোটা দলকেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *