উদ্ধার হলো না বাউনিয়া খাল

Slider সারাদেশ
উদ্ধার হলো না বাউনিয়া খাল

মিরপুরে ঢাকঢোল পিটিয়ে খাল দখলদারদের উচ্ছেদে অভিযান শুরু হলেও পরক্ষণেই তা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দখলদারদের হাত থেকে বাইশটেক নালা ও বাউনিয়া খালটি এবারও উদ্ধার করা গেল না।

এতে মিরপুরের কয়েক লাখ জনগোষ্ঠীর মধ্যে চরম ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে ঢাকার খাল-লেকগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করার উদ্যোগ বারবার হোঁচট খায়। উদ্যোগ নেওয়া হয় কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।ঢাকা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ঢাকা ওয়াসা ও উত্তর সিটি করপোরেশনের সহযোগিতায় ১৪ সেপ্টেম্বর এ উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হয়। ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইলিয়াস মেহেদীর নেতৃত্বে বাউনিয়া খালের ছোট নালা হিসেবে পরিচিত বাইশটেক খালে চালানো হয় উচ্ছেদ কার্যক্রম। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার অভিযানে ঝুপড়ি বস্তি স্টাইলের ৩০টি স্থাপনা উচ্ছেদ করেই ফিরে যান অভিযানকারীরা। উচ্ছেদ অভিযানকালে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইলিয়াস মেহেদী উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘খালগুলো ভরাট ও অবৈধ দখলের কারণে পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে গেছে। সামান্য বৃষ্টিতেই মিরপুর জুড়ে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা জবরদখলকৃত খালগুলো উদ্ধার করব। পুরো কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে। ’ কিন্তু বাইশটেক নালা ও বাউনিয়া খালের উচ্ছেদ অভিযান সেদিনই বন্ধ হয়ে গেছে। এ নিয়ে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে গোটা মিরপুর জুড়ে। চার নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র মো. জামাল মোস্তফা জানান, ঢাকা জেলা প্রশাসন ও ওয়াসার গাফিলতি আর খামখেয়ালিপনাতেই রাজধানীর খালগুলো জবরদখলমুক্ত হয় না। ফলে বৃষ্টি, বন্যা, জলাবদ্ধতায় ফিবছর নগরবাসী সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হন। তিনি বলেন, খাল উদ্ধারের উচ্ছেদ অভিযানসমূহে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ পরিবেশ সচেতন নাগরিকদের সম্পৃক্ত করা হয় না বলেই উচ্ছেদ অভিযানগুলো ব্যর্থ হয়। কোনো কোনো মহলের স্বার্থ হাসিল হওয়ামাত্র খাল উদ্ধারের অভিযান বন্ধ হয়ে যায় বলেও অভিযোগ করেন জামাল মোস্তফা। সরকার দীর্ঘদিন ধরে মহানগরীর সব খাল দখলমুক্ত করে তা পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ উদ্যোগের সুফল হিসেবে ইতিমধ্যে মিরপুর রূপনগরের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত দুয়ারীপাড়া খালটির অনেকাংশ পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। এর ফলে রূপনগরসহ মিরপুরের উত্তরাংশের বিশাল অঞ্চল বর্ষাকালেও আর প্লাবিত হয় না। স্থানীয় বাসিন্দা অধ্যক্ষ লিয়াকত হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, সম্প্রতি সরকার দুয়ারীপাড়া খালের প্রায় অর্ধাংশ ভরাট করে ৩০ ফুট প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু করায় আবারও জনভোগান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। সড়ক নির্মাণের কারণে ৪০ ফুট প্রশস্ত খালটি এখন নালা-ড্রেনে পরিণত হতে চলেছে। তিনি জানান, সংকুচিত খাল দিয়ে বিশাল এলাকার ড্রেনের বর্জ্য ও বর্ষাকালের বিপুল জলরাশি নির্গমন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। ফলে দুয়ারীপাড়া খালটিই এখন রূপনগরবাসীর অভিশাপ হতে চলেছে। জবরদখলে প্রায় মরে যাওয়া বাউনিয়া খালটি এখন বৃহত্তর মিরপুরবাসীর জন্য স্থায়ী অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার খোদ সরকারি উদ্যোগ-আয়োজনেই জবরদখলে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে বাউনিয়া খাল। মিরপুর-১৪ থেকে গোড়ান চটবাড়ী পর্যন্ত ১০-১১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ খালের প্রস্থ ৬০ ফুট। পুরাতন এয়ারপোর্ট, মিরপুর, পল্লবী, কাফরুল, ভাসানটেক ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকার সমুদয় পানি নিষ্কাশনের প্রধান পথ বাউনিয়া খালে সারা বছরই স্বচ্ছ পানির স্রোত বয়ে বেড়াত। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয়ের চলমান ভাসানটেক পুনর্বাসন প্রকল্প ও গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের জয়নগর প্রকল্পের নামে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে বাউনিয়া খালের অস্তিত্ব। খালের সিংহভাগ অংশ জবরদখল করে এসব প্রকল্পের বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন গড়ে তোলার উদ্যোগেই পানিপ্রবাহের পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ৬০ ফুট প্রস্থের খালটির অনেক জায়গায় এখন ৫-১০ ফুট নালার অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায় না। বাউনিয়া খাল দখলের চালচিত্র নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন ও নিউজ টোয়েন্টিফোর টিভি চ্যানেলে প্রতিবেদন প্রকাশের পর পরই ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকে মিরপুরের খাল উদ্ধার অভিযানের ঘোষণা দেওয়া হয়। পাঠানো হয় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযানকারী দল। কিন্তু উচ্ছেদ অভিযানকারীরা বাউনিয়া খালের সীমানায় পা না ফেলেই ফিরে গেছেন।

নিষ্ফল অভিযান বারবার : পরিকল্পিত উদ্যোগের অভাবে বারবার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েও রাজধানীর লেকগুলো রক্ষা করা যাচ্ছে না। কখনো বাসিন্দাদের উপর্যুপরি অভিযোগে, কখনো পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মুখে, আবার কখনো উচ্চ আদালতের কঠোর নির্দেশে তড়িঘড়ি উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। র‌্যাব-পুলিশের সহায়তা নিয়ে রাজউক, সিটি করপোরেশন, ওয়াসাসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা অবৈধ স্থাপনা, বস্তি, বসতি মুহূর্তেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। কিন্তু উচ্ছেদের মাধ্যমে ‘বেদখলমুক্ত’ জায়গা রক্ষায় আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। ফলে উচ্ছেদ অভিযান শেষ হতে না হতেই সেসব জায়গা আবার জবরদখল হয়ে যায়। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, খাল ও লেকসমূহের যেসব অংশে ওয়াকওয়ে ও ড্রাইভওয়ে নির্মাণ হয়েছে, সেসব অংশে লেক ঝুঁকিমুক্ত রয়েছে। দখলবাজদের সবচেয়ে বেশি থাবার শিকার গুলশান লেকের বনানী ও বারিধারা অংশে ওয়াকওয়ে তৈরির কারণে এখনো তা অক্ষত আছে। অভিন্ন চিত্র দেখা যায় ধানমন্ডি লেকেও। পরিবেশ-বিশেষজ্ঞরা জানান, রাজধানীর হৃৎপিণ্ড হিসেবে বিবেচিত খাল ও লেকগুলো বাঁচাতে পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে জরুরি। তারা বলেছেন, ‘লেক-খালে অবৈধ দখলদারবিরোধী উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েই দায়িত্ব শেষ করা উচিত নয়। সেগুলোকে পুনরায় দখল-দূষণের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে ওয়াকওয়ে, ড্রাইভওয়ে নির্মাণ ও গ্রিনবেল্ট গড়ে তুলতে হবে। তা করা হয় না বলে উচ্ছেদের দৌড়ঝাঁপ, অর্থ ব্যয় কোনো কাজে লাগে না। ’ রাজউক সূত্র জানায়, লেক রক্ষায় লেকের চারদিকে পায়ে হাঁটার জন্য ওয়াকওয়ে এবং গাড়ি চলাচলের জন্য ড্রাইভওয়ে নির্মাণসহ প্রতিরক্ষামূলক বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করতে ২০০৩ সালে রাজউক একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২৯০ কোটি টাকা। কিন্তু সরকারি পর্যায়েই নানা বাধা-আপত্তি ও অর্থাভাবের মুখে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে রাজউক আশানুরূপ উদ্যোগ নিতে পারেনি। লেকের যাবতীয় উন্নয়ন কাজ চালানো হচ্ছে ঢিমেতালে, থেমে থেমে। এসব কারণে লেক থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হলেও তা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। রাজউকের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা জানান, সড়ক ও জনপথ বিভাগ তাদের সম্পত্তি বেদখলমুক্ত করেই সেখানে নার্সারির জন্য স্বল্প মেয়াদে বরাদ্দ দিয়ে থাকে। একইভাবে সম্প্রতি রেলওয়ে তাদের নিজস্ব সম্পদ থেকে জবরদখলকারীদের হটিয়ে উভয় পাশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করে তা রক্ষার উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু নদী, খাল, বিল-ঝিল, লেক জবরদখল মুক্ত করে তা রক্ষার ব্যাপারে এ রকম কোনো পরিকল্পিত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

লেকপাড়ের উন্নয়ন কাজও বাধাগ্রস্ত : জবরদখলদারদের হটিয়ে লেক উদ্ধার করে পার ঘেঁষে রাস্তা নির্মাণ করেও তা রক্ষায় রাজউকের চরম ব্যর্থতার নজির রয়েছে। বারিধারার মার্কিন দূতাবাসের পাশ থেকে গুলশান লেক ঘেঁষে হাতিরঝিল পয়েন্ট পর্যন্ত চমৎকার একটি সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয় রাজউক। লেকের কিছু অংশ ভরাট করে এ রাস্তা নির্মাণের কাজ চলাকালেই বাড্ডা গুপীপাড়া রাস্তার মাথায় এবং লিংক রোড-সংলগ্ন স্থানে বেশ কয়েকটি পয়েন্টে নবনির্মিত রাস্তার অংশ জবরদখল করে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। সেসব স্থানে তারা রাতারাতি পাকা-আধাপাকা দোকানপাট-বাড়িঘর নির্মাণ করলেও রাজউক শুরুতে বাধা দেয়নি। বরং সংস্থাটির কতিপয় কর্মকর্তা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে দখলবাজদের আদালতে মামলা করাতেও উৎসাহিত করে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে সৃষ্ট মামলা জটিলতায় হাতিরঝিল কানেকটেড চমৎকার সড়ক প্রকল্পটি নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বেহাত হওয়া জায়গা দখলবাজদের অনুকূলে ছেড়ে দিয়ে আবারও লেকের পানিতে মাটি ভরাট করে রাস্তা নির্মাণের ফন্দি আঁটা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

২০ দফা উচ্ছেদেও টিকছে না খালটি : রাজউক, সিটি করপোরেশন ও ওয়াসা পৃথকভাবে ২০ দফা উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েও কল্যাণপুর খালটি রক্ষা করতে পারেনি। ওই খালে ২০০৭ সালেই ১১ দফা অভিযান চালিয়ে তা পুরোপুরি বেদখল মুক্ত করা হয়। কিন্তু এর পরও জবরদখলকারীদের দৌরাত্ম্যের কাছে সবকিছুই নিষ্ফল হয়ে পড়েছে। বারবার উচ্ছেদ শেষে কল্যাণপুর খাল জবরদখলমুক্ত করলেও অদ্যাবধি ওয়াকওয়ে নির্মাণ, খালপাড় বাঁধাই বা পাড় জুড়ে নার্সারির কোনো ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি। ফলে কয়েক দিনের ব্যবধানে আবার বেদখলের তথৈবচ অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং এখনো দখলকারীদের নিয়ন্ত্রণেই আছে খালটি। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কল্যাণপুর খালের একাংশ দখল করে সেখানে ‘৪১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগ’ সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দলীয় কার্যালয় বানানো হয়েছে। এ সুযোগে আশপাশে আবর্জনা, ইট-সুরকি, মাটি ভরাট করে গড়ে উঠেছে আরও কিছু স্থাপনা। সম্প্রতি কল্যাণপুর খালে অবৈধ দখল উচ্ছেদের সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য আসলামুল হক নিজেও সরাসরি বাধা হয়ে দাঁড়ান। সরকারদলীয় এ সংসদ সদস্যের বাধার মুখে ওয়াসা ও জেলা প্রশাসন কল্যাণপুর খাল দখলকারীদের উচ্ছেদ করতে পারেনি বলেও অভিযোগ রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *