মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতায় এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ১৭৬টি গ্রাম জনশূন্য হয়েছে বলে স্বীকার করেছে দেশটির সরকার। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির কার্যালয়ের মুখপাত্র জ তেই গতকাল বলেছেন, রাখাইন রাজ্যের তিনটি বসতিকেন্দ্রে মোট ৪৭১টি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রাম ছিল। এর মধ্যে ১৭৬টি গ্রাম অধিবাসীরা ছেড়ে গেছে। এছাড়া আরো অন্তত ৩৪টি গ্রামের কিছু অধিবাসী পালিয়ে গেছে। খবর এপি।
রাজধানী মিয়ানমারের নেপিদোয় মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ে গতকাল সন্ধ্যায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জ তেই এসব কথা বলেন। জনশূন্য হয়ে পড়া গ্রামগুলো সম্পর্কে আলোচনার সময় তিনি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। বরং মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী ‘বাঙালি’ বলে তিনি রোহিঙ্গাদের উল্লেখ করেন।
সু চির কার্যালয়ের মুখপাত্র আরো বলেন, যারা পালিয়ে গেছে, তাদের সবাইকে মিয়ানমার ফিরতে দেবে না। তিনি আরো বলেন, এদেরকে আমাদের যাচাই-বাছাই করতে হবে। যাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাবে, আমরা কেবল তাদেরকেই গ্রহণ করতে পারব।
এদিকে এএফপি জানিয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারে চলমান সহিংসতা ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নিপীড়নের বিষয়ে আলোচনার জন্য গতকাল এক জরুরি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হয়েছে। ব্রিটেন ও সুইডেনের অনুরোধে জাতিসংঘের সবচেয়ে ক্ষমতাধর অঙ্গটি এ বৈঠকে মিলিত হয়। বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় এ বৈঠক শুরু হয়।
নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক শুরুর কিছুক্ষণ আগে এক টুইট বার্তায় জাতিসংঘে ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত ম্যাথিউ রাইক্রফট বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর যে সহিংসতা চলছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তাতে চুপ থাকার সুযোগ নেই। নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য মিসরও রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তবে ভেটো ক্ষমতাধারী স্থায়ী সদস্য চীন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যেকোনো প্রস্তাবে বাদ সাধতে পারে। এর আগে আগস্ট মাসে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাব চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতার কারণে আটকে যায়।
মিয়ানমারের প্রতি হামলা বন্ধের আহ্বান: জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সহিংসতাকে জাতিগত নির্মূল অভিযান বলে অভিহিত করেছেন। নিউইয়র্কে বৈশ্বিক সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, রাখাইন রাজ্যে বেসামরিক মানুষের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর আক্রমণ ‘সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য’ ও ‘পীড়াদায়ক’। মিয়ানমার সরকারের প্রতি আমি সামরিক তত্পরতা ও সহিংসতা বন্ধ করার, আইনের শাসন বজায় রাখার এবং যাদের দেশ ছেড়ে যেতে হয়েছে, তাদের ফেরার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানাই।
রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নিপীড়নের বিষয়ে আলোচনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকের আগে জাতিসংঘ মহাসচিব এ সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় তাকে প্রশ্ন করা হয়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতিগত নির্মূল অভিযান চলছে বলে মনে করেন কিনা। জবাবে জাতিসংঘ মহাসচিব পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশকে যখন দেশ ছেড়ে পালাতে হয়, তখন বিষয়টির বর্ণনায় আর কোনো ভালো শব্দ পাওয়া যায় কি?
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজ মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি রাখাইন প্রদেশে জরুরি মানবিক সহায়তা প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করারও আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, মিয়ানমার সরকারের উচিত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অথবা আইনি স্বীকৃতি দেয়া, যাতে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।
আন্তোনিও গুতেরেজ রোহিঙ্গা সংকটের মূলোত্পাটনে ‘জরুরি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের জন্য মিয়ানমারের প্রতি তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, দশকের পর দশক ধরে এ সমস্যাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। বর্তমানে তা মিয়ানমারের সীমান্ত ছাড়িয়ে পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব সব দেশের প্রতি রোহিঙ্গাদের জন্য সম্ভব সব রকম মানবিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, মানবিক পরিস্থিতি বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে। মানুষ ক্ষুধার্ত, অপুষ্ট অবস্থায় আসছে এবং শরণার্থী শিবিরে ও স্থানীয় লোকালয়ে আশ্রয় নিচ্ছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে ৪০ দেশের কূটনীতিক : গতকাল উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন ৪০টি দেশের কূটনীতিক প্রতিনিধিরা। পরিদর্শন শেষে তারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। সাংবাদিকদের উদ্দেশে এক সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে তারা বলেন, একসঙ্গে এত মানুষকে আশ্রয় দেয়ার জন্য সত্যিই বাংলাদেশ প্রশংসার দাবি রাখে। আমরা আন্তরিকভাবে এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরব। মিয়ানমার সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাব, এই হামলা বন্ধ করে তারা যেন স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনে ও রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়। রোহিঙ্গাদের এই পরিস্থিতিতে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করছি।
প্রেস ব্রিফিংয়ে ব্রিটেন, চীন ও ভারতের কূটনীতিকরা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কুতুপালং নিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছান বিদেশী কূটনীতিকরা। এরপর তারা ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লক ঘুরে দেখেন এবং রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে নির্যাতনের বর্ণনা শোনেন। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাসহ (আইওএম) বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরিদর্শন শেষে প্রতিনিধিরা বিকালে ঢাকায় ফিরে আসেন।
এ পর্যন্ত এসেছে ৩ লাখ ৭৯ হাজার: চলতি সহিংসতায় মিয়ানমার থেকে মোট ৩ লাখ ৭৯ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার থেকে ২৪ ঘণ্টায় এসেছে নয় হাজার শরণার্থী। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর গতকাল এ কথা জানিয়েছে।
নতুন আসা শরণার্থীদের নিবন্ধন চলছে। এরই মধ্যে তাদের নতুন নির্ধারিত শরণার্থী শিবিরে স্থানান্তরের কাজ শুরু হয়েছে। সীমান্তের কাছেই শরণার্থীদের জন্য বড় ক্যাম্প নির্মাণের কাজ চলছে।
মিয়ানমারে সর্বশেষ সহিংসতার আগেও বাংলাদেশের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছিল। নতুন শরণার্থীর ঢলে আগের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ভিড়ে উপচে পড়ছে। এখনো হাজার হাজার শরণার্থী খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে।