মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ডে এখনো আটকা আছে লাখো রোহিঙ্গা। টেকনাফ সীমান্তে শাহপরীর দ্বীপের ১ নম্বর পিলার থেকে নাইক্ষ্যংছড়ির ফুলতলী ৪৮ নম্বর পিলার পর্যন্ত জিরো পয়েন্টগুলোয় এখনো রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।
তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারলেও ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যেতে পারছে তাদের স্বজনরা। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাও নানা সামগ্রী পাঠাচ্ছে নো ম্যান্স ল্যান্ডে। অন্যদিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বিজিপি নিয়মিত টহল দিচ্ছে জিরো পয়েন্টের ওপারে। রোহিঙ্গা নিধনে সীমান্তজুড়েই পুঁতে রাখা হয়েছে হাজার হাজার মাইন। গতকালও সকালে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম এলাকায় পরপর ১০টি স্থলমাইন বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শুনতে পান নো-ম্যান্স-ল্যান্ড ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। এখনো জ্বলছে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গা পাড়াগুলো। গতকাল বিকালে শাহপরীর দ্বীপের ওপারে মিয়ানমারের মংডুর গর্জনদিয়াসহ কয়েকটি এলাকা জ্বলতে দেখা যায়। গতকাল সরেজমিনে ঘুমধুম সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, জলপাইতলী ও তুমব্রুতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নো-ম্যান্স-ল্যান্ডে অবস্থান করছে। ২৫ আগস্ট তারা এই তাঁবুতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। এরপর ক্রমেই ঢল নামতে থাকে রোহিঙ্গার। কিন্তু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমানের দক্ষিণ তুমব্রু, রাইমংখালী, মেদি, কুয়াইংচিবং ও ঢেকিবনিয়ায় নিজ গ্রামে ফিরে যেতে পারছে না তারা। মগ ও বিজিপির কঠোর অবস্থান ও স্থলমাইন পুঁতে রাখায় তারা দীর্ঘদিন ধরে এই শিবিরে অবস্থান করছে। স্থলমাইন বিস্ফোরণে গত ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে চার রোহিঙ্গা নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে অন্তত ১৫ জন। তবে জিরো পয়েন্টের কোনারপাড়ায় পুঁতে রাখা ১০টি স্থলমাইন নিষ্ক্রিয় করে রোহিঙ্গারা। এ সময় তাজা আরও ৪টি মাইন কৌশলে উঠিয়ে ফেলা হয়। জানা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্য থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে পালিয়ে এসে উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয় লাখো রোহিঙ্গা। আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা ছাড়াও নো-ম্যান্স-ল্যান্ডে (জিরো পয়েন্ট) এখনো আটকে আছে আরও ২ লাখের ওপরে রোহিঙ্গা। সীমান্তের এপারে চলে আসা রোহিঙ্গারা যাতে ওপারে পুনরায় ফিরে যেতে না পারে সেজন্য জিরো পয়েন্টে কাঁটাতারের বেড়ার কাছাকাছি পুঁতে রাখা হয়েছে স্থলমাইন। ২৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী নতুন করে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, জ্বালাও-পোড়াও শুরু করলে রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসার জন্য সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অবস্থান নেয়। বিজিবি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর কড়া বাধার মুখে বেশ কয়েক দিন সীমান্তে অপেক্ষার পর ঈদুল আজহার দিন থেকে মানবিক বিবেচনায় সরকার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে নমনীয় হলে অদ্যাবধি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশও (বিজিবি) মানবিক কারণে আগের মতো আর রোহিঙ্গা ঠেকাতে হার্ডলাইনে না যাওয়ায় বানের স্রোতের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে থাকে বাংলাদেশে। গতকালও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটে। সীমান্ত পেরিয়ে আসা হাজার হাজার রোহিঙ্গা পরিবারকে টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ থেকে উখিয়ার কুতুপালং পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে বন বিভাগের ১০ হাজার একর জায়গায় আশ্রয় দেওয়া হয়। বিশেষ করে কুতুপালং, লম্বাশিয়া, মধুরছড়া, বালুখালী, বালুখালী ঢালার মুখ, থাইংখালী, হাকিমপাড়া, পালংখালী তাজনিরমারখোলা, পালংখালীর বাঘঘোনা ও জামতলী বস্তিতে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা।ত্রাণের জন্য দিগ্বিদিক ছোটাছুটি : ত্রাণের জন্য গতকালও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান ত্রাণ বিতরণ করলেও কোনো শৃঙ্খলা না থাকায় তা কেউ পাচ্ছে কেউ পাচ্ছে না। উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী শরণার্থী শিবিরে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অর্ধেকের বেশি শরণার্থী উল্লেখ করার মতো কোনো ত্রাণ পায়নি। কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে কথা হয় তিন দিন আগে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী আবুল কালামের সঙ্গে। তিনি জানান, গত তিন দিনে তিনি একবার এক পোঁটলা ভাতের দেখা পেয়েছেন, আরেকবার কিছু বিস্কুট আর চিঁড়া পেয়েছেন।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হেঁটে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুরা দীর্ঘদিন না খেয়ে অনাহারে দিনাতিপাত করছে উখিয়ার বিভিন্ন ঝুপড়িতে। স্থানীয় দানশীল ব্যক্তি ও সংগঠন এসব ক্ষুধার্ত অসহায় রোহিঙ্গাকে কলা, বিস্কুট, চিঁড়া, গুড়, মুড়ি, খিচুরিসহ খাবার, কাপড় বিতরণ করে গেলেও না খেয়ে আছে অনেক রোহিঙ্গা। যার ফলে গাড়ি দেখলেই ছুটতে থাকে রোহিঙ্গারা। উপজেলা প্রশাসন ত্রাণসামগ্রী বিতরণ কাজের সুবিধার্থে ত্রাণ বিতরণের জন্য কন্ট্রোল রুম খুলেছে। সরেজমিন কুতুপালং নতুন বস্তি এলাকা টিভি রিলে কেন্দ্রের পাশে দেখা যায়, স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ব্যানারে কিছু যুবক ট্রাকে করে খিচুরি রান্না করে এনেছে ক্ষুধায় কাতর রোহিঙ্গাদের জন্য। ট্রাকের ওপর থেকে একটি খিচুরির প্যাকেট দিতে গেলেই একসঙ্গে হাজারের অধিক রোহিঙ্গা ঝাঁপিয়ে পড়ে। কুতুপালং রাস্তার পাশে আশ্রয় নেওয়া বয়োবৃদ্ধ রোহিঙ্গা খুইল্যা মিয়া (৭৯) বলেন, ‘আমার পাশে যারা আছেন তারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ত্রাণ পেয়ে থাকলেও আমি এ পর্যন্ত কিছুই পাইনি। ’ রত্নাপালং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল কবির চৌধুরী বলেন, ‘রাস্তার ওপর গাড়ি থামিয়ে খাবার ও অন্যান্য মালামাল বিতরণ করার কারণে কুতুপালং থেকে পালংখালী দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। ’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাঈন উদ্দিন বলেন, ‘যত্রতত্র ত্রাণ বিতরণের কারণে সড়কে যানজট হচ্ছে। সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণের জন্য ব্যক্তি বা সংগঠনের উদ্যোগে দেওয়া ত্রাণগুলো কন্ট্রোল রুমে জমা দিলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তা রোহিঙ্গাদের মাঝে বিলি করবেন। এতে সবাই ত্রাণসুবিধা পাবেন। ’
মূল জনস্রোতে মিশে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা : কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, রোমাসহ বিভিন্ন এলাকায় কয়েক দিন ধরে আসা প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গার অনেকে এখন দেশের মূল জনস্রোতের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি দেশের সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নসহ সাধারণ জনগোষ্ঠীর মাঝেও এক ধরনের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। স্থানীয় কিছু দালাল শ্রেণির লোক চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে বলে প্রশাসনসূত্রে জানা গেছে। র্যাব-৭ কক্সবাজারসূত্রে জানা গেছে, গত দুই দিনে শুধু কক্সবাজার-টেকনাফের লিঙ্ক রোডের মুখে চেকপোস্ট বসিয়ে দুই শতাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আটক করা হয়েছে। তারা মিনিবাস ও বিভিন্ন ছোট ছোট যানবাহনে করে চট্টগ্রাম অভিমুখে যাওয়ার উদ্দেশে ওই পথ দিয়ে আসছিল।
সূত্র জানায়, উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী ও টেকনাফের লেদা-মুছনী শরণার্থী ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে মূল স্রোতের সঙ্গে মিশে যেতে শুরু করেছে। বিশেষ করে যাদের পরিবারের সদস্যরা মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ প্রবাসে রয়েছে, যাদের আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালো তারা শহরে বাসা ভাড়া করে থাকা শুরু করেছে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে আবার অনেকে কাজের সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে র্যাব-৭-এর কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গারা এখন বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। দুই দিন ধরে এ রকম শতাধিক রোহিঙ্গাকে লিঙ্ক রোডের চেকপোস্টে আটক করে তাদের পুনরায় নির্দিষ্ট শরণার্থী শিবিরগুলোয় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তা না হলে তারা জেলা ও উপজেলা শহরগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়বে। এতে আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সামাজিক নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। ’
‘রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস গণহত্যা চলছে’ : আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে মিয়ানমার এখনো রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক। মিয়ানমারের রাখাইনে মুসলমান নিধন অভিযান চলছে এবং ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় কিছু প্রভাবশালী রাষ্ট্রের মদদে আরাকানকে খালি করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। এ গণহত্যাকে তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে নির্মম এবং জঘন্যতম গণহত্যা উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এর বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার কথাও জানান। মিয়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে কক্সবাজারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে গতকাল সকালে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন রিয়াজুল হক। এ সময় তিনি এই গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তোলার প্রক্রিয়ার কথাও জানান। এ ছাড়া কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নানা বিষয়ে খোঁজখবর নেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান।
সৈকতে ভেসে এলো রোহিঙ্গা কিশোরীর লাশ : কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া সমুদ্রসৈকত থেকে সোমবার সকালে এক রোহিঙ্গা কিশোরীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে নৌপথ পাড়ি দিতে গিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় নৌকাডুবির ঘটনায় নিহত ৯৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
[রিপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার প্রতিনিধি আয়ুবুল ইসলাম, উখিয়া প্রতিনিধি শফিক আজাদ ও টেকনাফ প্রতিনিধি আবদুস সালাম]।